‘খেলা হবে’ বাহাসে সংঘাতের আলামত

0
146
অধ্যাপক আ আ ব স আরেফিন সিদ্দিক, ড. শাহ্দীন মালিক, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. আবদুর রাজ্জাক

রাজনীতিতে সংঘাত-সহিংসতা বাড়ছেই। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে এই অবস্থা আরও প্রকট রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘খেলা হবে’ বক্তব্যের জবাবে বিএনপি নেতারাও ‘পাল্টা খেলার’ হুঁশিয়ারি দেওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমে নাজুক হয়ে পড়ছে।

রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কিন্তু সংঘাতময় যে পরিস্থিতি চলছে, সেটা থামার আপাতত লক্ষণ নেই। বিশেষত রাজনীতির মাঠের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি, উত্তপ্ত বক্তৃতা প্রায়ই রাস্তায় কর্মীদের মধ্যে ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সহিংসতা যেমন থামানো দরকার, তেমনি নেতাদের ‘মুখের লাগাম’ও টেনে ধরা প্রয়োজন। নয়তো পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত জুলাইয়ের শেষভাগ থেকে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি হয়। তখন জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও তার মিত্ররা কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে গণজমায়েত শুরু করে। আওয়ামী লীগ নেতারাও ‘বসে থাকবে না’- এমন ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন ‘কঠোর হস্তে প্রতিহত করা হবে’ বলে জানিয়ে আসছেন।

জ্বালানি-দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইস্যুতে গত ২৯ জুলাই থেকে বিএনপি বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয় এবং পুলিশও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে হস্তক্ষেপ করে। আগস্টের শেষ তিন সপ্তাহে বিএনপির অন্তত তিনজন কর্মী-সমর্থক নিহত হয়। বাধা পেয়ে বিএনপি কর্মীরাও নেতাদের আহ্বানে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে রাস্তায় নামে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে বিএনপি ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি শুরু করলে প্রতিটি সমাবেশের আগে দৃশ্যত সমাবেশ সীমিত রাখার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে বাস-লঞ্চসহ মোটরচালিত গণপরিবহনে ‘হরতাল’ ডাকায় প্রবল জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। মালিক-শ্রমিকদের তরফ থেকে হরতাল ডাকার কথা বলা হলেও জনগণ সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে। একই রকম পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর ও সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশ হয়েছে। পরস্পর বিরোধিতা ও মৌখিক আস্ম্ফালন সত্ত্বেও উভয় পক্ষের সংযমের ফলে বড় রকম সহিংসতা ঘটেনি, তবে জনমনে অস্বস্তি ও শঙ্কা রয়েছে। আগামী ২৬ নভেম্বর খুলনা ও ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর গণসমাবেশ শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে এই কর্মসূচি শেষ হবে।

ঢাকার মহাসমাবেশের আগে-পরে ঢাকা মহানগরীতে নানা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এরই মধ্যে ১১ নভেম্বর যুবলীগের যুব মহাসমাবেশ, ২৯ অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবং গত রোববার উত্তরা ছাড়াও রাজধানীতে আরও কয়েকটি শান্তি সমাবেশে বিশাল জনসমাগম ঘটিয়ে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে রেখেছেন তাঁরা। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দেওয়ায় আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে আরও উদারতা দেখাতে হবে। সরকার সমর্থক পরিবহন ইউনিয়নকে দিয়ে ‘পরিকল্পিত’ পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে বাধা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। বিএনপিকেও সহনশীলতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে মনোযোগী হতে হবে।

বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, ২৯ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৯২টি স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে সরকার সমর্থক ও পুলিশের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন তিনজন। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে ২০ থেকে ২৫টি স্থানে। মামলা হয়েছে ৭২টি। আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী। গ্রেপ্তার চার শতাধিক। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি প্রায় ২৫ হাজার। এর পরও গত কয়েক দিনে রাজধানীর পল্লবী, বনানী ও মুন্সীগঞ্জে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদলের একজন স্থানীয় নেতা নিহত হয়েছেন।

তবে আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলের পাশাপাশি তাদের নেতাকর্মীর উস্কানিমূলক অপতৎপরতার কারণেই কোথাও কোথাও সংঘাত-সহিংসতা ঘটছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সন্ত্রাস-সহিংসতা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, সংঘাত-সহিংসতাময় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধানতম উপায় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখানো এবং পরমতসহিষুষ্ণতা প্রদর্শন করা। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিও প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও হুমকি-ধমকি বড় সংকটাবস্থার পূর্বাভাস। এটা ক্রমাগত সংঘাত-সংঘর্ষ ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির ইঙ্গিতও বহন করছে। তাই উভয় দলকে পারস্পরিক বিরুদ্ধ অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতার জন্য কিছু কমন গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশ, জাতি ও সমাজের অমঙ্গল অবধারিত।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছাড় দিয়ে সমাধানের পথ হতে পারে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার চলাফেরা, সভা-সমাবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংগঠন করা- সংবিধান অনুযায়ী এগুলো মৌলিক অধিকার। এগুলোতে বাধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই সব পক্ষকেই একে অপরের প্রতি সহনশীল হতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় দুটি দলই চিল্লাচিল্লি করে বলছে যে রাজপথ তাদের দখলে রাখবে। কিন্তু রাজপথ শুধু আওয়ামী লীগ আর বিএনপির সম্পত্তি নয়; রাজপথ জনগণের সম্পত্তি। এবার শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বামপন্থিরাও রাজপথে থাকবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই খেলা প্রতিযোগিতার চির অবসান ঘটানোর জন্য বিকল্প তৈরি করবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর বা আগে-পরের কর্মসূচি ঘিরে কিছুই হবে না। এ নিয়ে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কাও নেই। বিএনপি মহাসমাবেশ করছে, করুক। ওই মহাসমাবেশ থেকে ওরা হুংকার দিয়ে চলে যাবে। আবার আরেকটা তারিখ দেবে, আগের মতো। সেই ঈদের পরে তাদের আন্দোলনের মতো।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি হুমকি-ধমকি দিচ্ছে না। সরকারই রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে, দলীয় ক্যাডারদের মাঠে নামিয়ে বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে, হামলা করছে, হত্যা করছে, মামলা দিচ্ছে। মামলা মামলা খেলা শুরু করেছে। গায়েবি মামলা দিচ্ছে। কিন্তু এবার কোনো হুমকি-ধমকিতে লাভ হবে না। মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর ফিরবে না।

অমরেশ রায় ও কামরুল হাসান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.