‘আদিম যুগে’ তেলেগুরা

0
150
সবই ছিল তাদের। উচ্ছেদের পর অল্প পরিসরে কিছু পরিবারকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। গ্যাস বিদ্যুৎ পানি নেই। শুধু ১০ ফুট বাই ১৫ ফুট ডেরা তোলার অনুমতি মিলেছে। রাজধানীর ধলপুরের তেলেগু বস্তির বর্তমান

যখন মন চায় তখনই আমাদের ঘর ভেঙে দেয়। নতুন করে জায়গা, আর্থিক সহায়তা দেয় না। বস্তি ভাঙার পর অনেকে আত্মীয়স্বজন বা অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের ঘরেও থাকার জায়গা নেই। আমাদের অবস্থা আদিম যুগের মানুষের মতো। কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর ধলপুরে ভেঙে দেওয়া তেলেগু বস্তির এরাম শেট্টি গণেশ।

হাজারখানেক তেলেগুর (মেথর) ওই বস্তি গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। অমানবিক পরিস্থিতিতে রাতদিন পার করছে শতাধিক পরিবার। সিটি করপোরেশন বস্তির পাশেই প্রতিটি পরিবারকে ১৫০ বর্গফুট আয়তনের জায়গা দিয়েছে। তবে ঘর বানানোর সামর্থ্য নেই তাদের। দু-চারটি পরিবার চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ঘর তোলার চেষ্টা করছে। অনেকেই আত্মীয়স্বজন ও পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের সঙ্গে গাদাগাদি করে রাত যাপন করছেন।

তেলেগুরা বলছেন, ব্রিটিশ সরকার ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্য থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল ‘জাত মেথর’ হিসেবে কাজ করানোর জন্য। তখন দেশের বিভিন্ন শহরে ‘মেথরপট্টি’ গড়ে তুলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালের পর সেসব বাসস্থান থেকে বিভিন্ন সময় তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ১৪ নম্বর আউটফল কলোনিতে থিতু হয়েছিলেন তাঁরা। পরে সেটির নাম হয় তেলেগু বস্তি। এখন তাঁদের মাথার ওপর থেকে সেই ছাতাও সরে গেছে।

তবে ডিএসসিসি বলছে, তাদের ১৫ একর জায়গার একাংশে তেলেগু সম্প্রদায় বসবাস করত। বাকি জমি দখল করে অসাধু চক্র বস্তি-দোকানপাট বানিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসে। তেলেগুদের বসবাসের স্থাপনাগুলো দীর্ঘদিনের পুরোনো। সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল খালি করতে। নতুন দুটি ছয়তলা কোয়ার্টার বানিয়ে তাঁদের বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হবে। কিন্তু তাঁরা তাতে কর্ণপাত করেননি। এ জন্যই তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়।

উচ্ছেদ অভিযানের পরই এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ডিএসসিসি। মানবাধিকার কমিশন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মানবাধিকার কর্মীরা পুনর্বাসন ছাড়া তাঁদের উচ্ছেদ করায় কঠোর সমালোচনা করেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে একটি চিঠি দেন যেন তাঁদের পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করা না হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ১২৬টি তেলেগু পরিবারকে ১০ ফুট প্রস্থ ও ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি করে জায়গা অদূরেই সুতা দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সেখানে ঘর বানিয়ে তারা আপাতত থাকবে।

তেলেগুদের অভিযোগ, তাঁদের পেশা থেকে সুপরিকল্পিতভাবে উৎখাত করে বাঙালিদের নিয়োগের জন্য মেথরদের ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ নাম দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মেথরদের জাত পেশা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্য কোনো পেশায় তাঁদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়নি।

সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ঘরের ইটপাটকেল পরিষ্কার করছেন কিছু শ্রমিক। ভেঙে দেওয়া কলোনির পশ্চিম পাশের কোনায় ডিএসসিসির চিহ্নিত জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়ে তুলতে কাজ করছেন তেলেগুদের কয়েকজন। তেলেগু কলোনির জায়গায় এখন শুধু একটি এনজিওর স্কুল, দুটি গির্জা ও একটি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। তেলেগু ভাষায় একজন বললেন, ‘রক্কা আড়িতেনে গানি ডোক্কা আড়াদু’ অর্থাৎ হাত কাজ না করলে পেট ভরবে না। সনাতন ধর্মাবলম্বী তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকজন ‘লুকামিবিকা বা লোকালতেল্লি’ দেবীর একটি মন্দির গড়ে তুলেছেন। ঘরে নতুন ধান বা নতুন কিছু এলে এ দেবীর পূজা করে কাজ শুরু করেন তেলেগুরা। দুয়েকজন যাঁরা টিনশেড ঘর বানাতে পেরেছেন, তাঁরা এই দেবীর পূজা করে সেখানে উঠবেন।

তেলেগুদের নেতা ইয়ারাম শেট্টি ভাঙকাটেস (৪২) বলেন, ব্রিটিশরা তাঁদের এনে এক গ্রুপকে চা বাগানে পাঠায়। আরেক গ্রুপকে নগরীর পরিচ্ছন্নতার কাজে লাগিয়ে দেয়। কিন্তু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। সব সময় তাঁদের মেথর বলে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

তেলেগুরা জানান, প্রতিটি পরিবার ছোট্ট একটি কক্ষে গাদাগাদি করে বাস করত। কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে কলোনি ভেঙে দেওয়া হয়। ঘর তৈরির জন্য আর্থিক সহযোগিতাও করা হয়নি। দুর্গা শেট্টি নামে একজন বৃদ্ধ বলেন, ‘যখন এখানে সুইপারের কাজ করার কেউ ছিল না, তখন সরকার আমাদের এনেছে। এখন তো সুইপারের কাজও পাই না। ঘর হারিয়ে কারও ঘর করার টাকাও নেই। থাকার জায়গা নেই। খাবার নেই। আমরা যাবো কোথায়?’ নাগরাজ (৬৫) বলেন, ‘ছোট থাকতে ছিলাম টিকাটুলির কলোনিতে। সেখান থেকে এরশাদ আমলে নিল সায়েদাবাদ। পরে সায়েদাবাদ থেকে উজিরবাড়ি। সেখানে ৩৫ বছর থাকার পর ধলপুরের এই কলোনিতে আসি। ১৯৯৫ সালে কলোনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন ঘরই ভেঙে দেওয়া হলো।’

সুইপার কলোনির সিঙ্গাম পেল্লি ঝুমুরের কৈশোর পার না হলেও কোলে আট মাস বয়সী সন্তান। তিনি বললেন, ঘর ভেঙে দেওয়ার পর পাশের কোয়ার্টারে এক পরিবারের সঙ্গে থাকছি। সেখানে তাঁরাই এক রুমে থাকেন ছয়জন। সুদে ঋণও কেউ দিতে চাচ্ছে না। কারণ এখন দু’জনেরই কোনো কাজ নেই।

এরই মধ্যে একটি ঘর তুলেছেন তেলেগু পরিবারের মনির। তাঁর বাবা মুসলমান, মা তেলেুগু। তিনি জানান, মাসিক ৫ শতাংশ সুদে একজনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ঘর তুলেছেন। মাসিক সুদ দিতে হবে, সংসারও চালাতে হবে। তাঁর মা বঙ্গভবন স্টেডিয়ামে সুইপারের চাকরি করতেন। মায়ের পেনশনের টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করবেন।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘উচ্ছেদের খবর পাওয়ার পরই সেখানে গিয়েছিলাম। মেয়রকে বলেছিলাম তাঁদের উচ্ছেদ করা যাবে না। পরে মেয়র বলেছেন, তেলেগুদের জন্য দুটি ছয়তলা ভবন পাশেই বানিয়ে দেবেন। তখন আমরা বললাম, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু পরে কী হয়েছে আর জানতে পারিনি। শুনেছি এখন তাঁদের পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, মাথার ওপর ছাদও নেই।’

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ জন্য তাঁরা নোটিশ দিয়েছেন। কয়েকটা মন্দির আছে, স্কুল আছে। সিটি করপোরেশনের কমিটমেন্টটা কী, সেটা তাঁরা জানতে চান। কারণ সিটি করপোরেশনের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, এরই মধ্যে ১২৬টি তেলেগু পরিবারকে তাদের জায়গা খুঁটি দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। নতুন ভবন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানে ঘর তুলে থাকবেন। ১০টি টয়লেটও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও ১০টি টয়লেট তৈরি করে দেওয়া হবে। মন্দির ও গির্জার জন্যও জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.