বেদখল হওয়া এসব বাড়ি উদ্ধার করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর স্থাপনের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সরকার ৫৫টি পরিত্যক্ত বাড়ি বা সম্পত্তি উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই রয়েছে ৫১টি বাড়ি। ঢাকার পরিত্যক্ত বাড়ির দখলদারদের তালিকায় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, আবাসন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। বেদখল হওয়া এসব বাড়ি উদ্ধার করে সেখানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর স্থাপনের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
আইন অনুযায়ী, পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলতে সেই ব্যক্তির মালিকানাধীন সম্পত্তি বোঝায়, যিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে অনুপস্থিত ও সন্ধানহীন। অন্যভাবে বলা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যেকোনো সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে অথবা সামরিক সংঘাতে লিপ্ত থাকা কোনো নাগরিকের সম্পত্তি।
সহজ করে বললে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নাগরিক তাঁদের বাড়ি বা সম্পত্তি ফেলে চলে গেছেন, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সেসব সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নথির তথ্য অনুযায়ী, বেদখল হওয়া ঢাকার ৫১টি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকাতেই রয়েছে ২৩টি। মিরপুরে আছে ১০টি, মতিঝিলে ৩টি, পল্টনে ৩টি, লালবাগে ৩টি, শাহবাগে ১টি, লালমাটিয়ায় ১টি, মগবাজার দিলু রোডে ১টি, নিউ ইস্কাটনে ১টি, তেজগাঁওয়ে ১টি, সূত্রাপুরে ১টি, শাঁখারাজীবাজারে ১টি, নন্দলাল দত্ত লেনে ১টি এবং আর কে মিশন রোডে ১টি। এর মধ্যে নিউ ইস্কাটনের পরিত্যক্ত বাড়িটির আয়তন এক বিঘার বেশি। পল্টনের বাড়িটি (৩/৫ পুরানা পল্টন) সাড়ে ২৬ কাঠা, শাহবাগের (৭ ময়মনসিংহ রোড) বাড়িটি ২২ কাঠা এবং সূত্রাপুরের বাড়িটি প্রায় ২০ কাঠা।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও লালমনিরহাটে একটি করে পরিত্যক্ত বাড়ি চিহ্নিত করেছে সরকার। সব মিলিয়ে মোট ৫৫টি বাড়ি এ বছরের মধ্যেই উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এসব বাড়ি অধিগ্রহণ করতে গত মার্চ মাসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা কয়েক দফায় পরিত্যক্ত বাড়িগুলো সরেজমিনে দেখে এসেছেন। পরিত্যক্ত এসব বাড়ির জমির দাম নির্ধারণ করতে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে বৈঠকও করেছেন তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে গত মার্চের শেষ সপ্তাহে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছে । তখন তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে যাঁরা সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে বসবাস করছেন, তাঁদের কাছ থেকে সম্পত্তি দখলে নেবে সরকার। কেউ যদি সম্পত্তি নিজের প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ঢাকার যেসব পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকার উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেসব জমি আয়তনে বেশ বড়। জমির অবস্থানও ভালো জায়গায়।
তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, এসব পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে ৪৯টির বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। তবে মামলা চললেও এসব বাড়ি অধিগ্রহণে তা কোনো বাধা হবে না। এর কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয় বলছে, সরকার যেকোনো পরিত্যক্ত সম্পত্তি যেকোনো যুক্তিসংগত, উপযুক্ত ও ন্যায়সংগত উপায়ে নিষ্পত্তি করতে পারে। এ ক্ষমতা আইনগতভাবে সরকারের রয়েছে। তবে আদালতের রায়ে কেউ জমির মালিক হয়ে থাকলে এবং তিনি উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
সরকারি বিধি মোতাবেক পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়া ও পরিত্যক্ত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড রয়েছে। এ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই সাড়ে ছয় হাজারের মতো পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাড়ি রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে কতটি, সে তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি বোর্ডের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকায় বেদখল হওয়া ৫১টি পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাড়ির কোনোটিতে বহুতল মার্কেট, কোনোটিতে হোটেল, বেসরকারি কলেজও গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে দখলদারদের মধ্যে রয়েছে বিএনএস গ্রুপ, হ্যাক সিকিউরিটিজ কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে যা দেখা গেল
ঢাকার ৫১টি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে গত মার্চ মাসে ১৫টি বাড়ি ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে মতিঝিল সিটি সেন্টারের পাশে ১২৬ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। সেখানে চারতলা পুরোনো একটি ভবন রয়েছে। এই বাড়ি বিএনএস গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এম এন এইচ বুলুর দখলে আছে। ৭ দশমিক ৫ কাঠার ওপর গড়ে তোলা চারতলা ওই ভবনে মক্কা গ্রুপ, ইস্টার্ন ব্যাটারিজ, ফরচুন এয়ার ট্রাভেলস, মেসার্স নোভা ট্রাভেলসের কার্যালয় রয়েছে।
বিএনএস গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এন এইচ বুলু বলেন, ‘একসময় জমিটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল। পরে অবমুক্ত করা হয়েছে। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই জমির মালিক এখন আমরা।’ তিনি বলেন, ‘এখন সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে বহুতল ভবন করবে, জমি অধিগ্রহণ করবে, দেশের স্বার্থে সরকার যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বাধা দেব না, মেনে নেব।’
রাজধানীর ৪ ও ৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাশাপাশি দুটি বাড়িও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। প্রায় ১৯ কাঠা জমির ওপর সেখানে একটি চারতলা ও একটি একতলা ভবন করা হয়েছে। এটি এখন ‘হ্যাক সিকিউরিটিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। হ্যাক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লায়েক আলী চৌধুরী বলেন, জমির মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে রায় পেয়েছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘শুনেছি সরকার এখন এই জমি অধিগ্রহণ করবে। সরকার যদি জমির সঠিক দাম দেয়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি জমির ন্যায্য দাম না দেওয়া হয়, তবে আমরা আদালতের আশ্রয় নেব।’
মগবাজারের দিলু রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িতে আটতলা আরকে টাওয়ার গড়ে তোলা হয়েছে। টাওয়ারটি করেছেন রংপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এমদাদুল হক ভরসা। তবে পরিত্যক্ত ওই সম্পত্তির মালিক জীবন মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে চুক্তিতে ভবনটি করা হয়েছে। এমদাদুল হক ভরস বলেন, ওই জমি যে পরিত্যক্ত সম্পত্তি, তা তিনি জানতেন না।
আরকে টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক জিন্নাত হাওলাদার জানান, আটতলা এই ভবনে মোট ২১টি ফ্ল্যাট আছে। এর মধ্যে ১১টি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। বাকিগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে।
শাহবাগে ময়মনসিংহ রোডের ৭ নম্বর বাড়িটিও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এখানে ২২ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা দুটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
৩৮৮ নিউ ইস্কাটনের পরিত্যক্ত বাড়িটি এক বিঘা জমির ওপর। সেখানে দোতলা ভবনে শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন ও শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হকের পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে এই বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে রায়ে দুই পরিবারকে সেখানে বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের পর সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শহীদ পরিবারের সদস্যদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হবে।
মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের ডি ব্লকের এম ৮ নম্বর প্লটটিও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এই জায়গা ঢাকা ওয়াসার পরিদর্শক হারুন অর রশিদের দখলে রয়েছে। ১ দশমিক ৮ কাঠার ওই জমিতে একটি পুরোনো তিনতলা ভবন রয়েছে। হারুন অর রশিদ অবশ্য ওই বাড়িতে থাকেন না। ভবনটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।
হারুন কাছে দাবি করেন, এ বাড়ির মালিকানা নিয়ে আদালত তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি ব্লকের ১১/১৮ নম্বর বাড়িটি ডা. মোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যক্তির দখলে রয়েছে। সেখানে একটি চারতলা ভবন রয়েছে। মোফাজ্জল হোসেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। মোহাম্মদ সোহেল নামের এক ব্যক্তি ওই বাড়ি দেখভাল করছেন। সোহেল দাবি করেন, এই বাড়ির মালিকানা নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। জমির মালিকানা মোফাজ্জল হোসেন পেয়েছেন। তবে এই দাবির পক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তিনি।
পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকারের দখলে নেওয়ার উদ্যোগের বিষয়ে সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব সম্পত্তি দখলে নেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হবে। কারণ, জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম আকাশচুম্বী। নিয়ম অনুযায়ী বর্তমান বাজারদরের তিন গুণ জমির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে জমির বর্তমান মালিকের সমঝোতা হতে পারে। তবে আদালতেই বিষয়টির নিষ্পত্তি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।