
ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিদিন কত কিছুই তো ঘটে। এর মধ্যে কিছু দিন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনা ও ভারতবাসীর কাছে যেমন ২৫ জুন তেমনই এক দিন।
৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ৪২ বছর আগে এই দিনেই সবাইকে চমকে দিয়ে ভারত জিতেছিল নিজেদের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ।
নিজেদের মাঠ বুয়েনস এইরেসের এস্তাদিও মনুমেন্তালে ১৯৭৮ ফাইনালে দানিয়েল পাসারেলার আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে হারায় নেদারল্যান্ডসকে। আর লর্ডসে ১৯৮৩ ফাইনালে কপিল দেবের ভারত সেই সময়ের মহাপরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারায় ৪৩ রানে।
ঐতিহাসিক দুই ফাইনাল আরেকবার ফিরে দেখা যাক—
২৫ জুন ১৯৭৮: আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনাল
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। কিন্তু হারতে হয় স্বাগতিক উরুগুয়ের কাছে। এরপর চার দশকের বেশি সময়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দূরে থাক, শেষ চারেও উঠতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
অবশেষে ১৯৭৮ সালে নিজেদের মাটিতে প্রথমবার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করে তারা। সিজার লুইস মেনোত্তির দল নকআউট পর্বে ওঠার পর তাদের আর আটকে রাখা যায়নি।

৬ গোল করে সেবার গোল্ডেন বুট জেতেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড মারিও কেম্পেস। বিশ্বকাপের পাশাপাশি আর্জেন্টিনা জিতে নিয়েছিল ফিফা ফেয়ার প্লে ট্রফিও। ৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে ফাইনাল হয়েছিল রিভার প্লেটের মাঠ এস্তাদিও মনুমেন্তালে। আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় টোটাল ফুটবলের জনক নেদারল্যান্ডস।
৩৮ মিনিটে কেম্পেসের গোলেই এগিয়ে যায় স্বাগতিকেরা। ৮২ মিনিটে ডিক নান্নিঙ্গার গোলে ডাচরা সমতা ফেরালে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে আরও দুই গোল করে আর্জেন্টিনা—১০৫ মিনিটে কেম্পেসের পর ১১৫ মিনিটে দানিয়েল বেরতনি।
তবে এই আসর ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্বকাপ’ হিসেবে মনে রাখা হয়েছে। সব বিতর্ক আয়োজক আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই। বিশ্বকাপ শুরুর দুই বছর আগে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে অপসারণ করে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা। এরপর গোটা দেশ পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়।

ভিদেলা চেয়েছিলেন, আর্জেন্টিনা যেন যেকোনো মূল্যে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতে। তাঁর ধারণা ছিল, এতে তাঁর সব অপশাসন ঢাকা পড়বে। এ লক্ষ্যে তাঁর কূটকৌশল বিশ্বকাপেও প্রয়োগ করেন।
তর্কসাপেক্ষে নেদারল্যান্ডস ইতিহাসের সেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফ এই বিশ্বকাপে খেলেননি। পরে জানা যায়, বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে ক্রুইফ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অপহরণের চেষ্টা করা হয়। এতেই ভয় পেয়ে আর্জেন্টিনায় খেলতে যাননি। ক্রুইফ না থাকলেও ফাইনালে ওঠে নেদারল্যান্ডস।
সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয় আর্জেন্টিনা-পেরু ম্যাচ নিয়ে। সেই ম্যাচে পেরুর ৬ গোল খাওয়া আজও রহস্য হয়ে আছে। পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালের পথে অনেকটাই এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ফলে ফাইনালে উঠতে হলে একই দিনে আর্জেন্টিনাকে পেরুর বিপক্ষে অন্তত তিন গোলে জিততে হতো। রোজারিওতে হওয়া সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা দেয় ৬ গোল!

আর্জেন্টিনার শাসক ভিদেলা নাকি সেদিন তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে পেরুর খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, আমরা তোমাদের লাতিন ভাই, আমরা এক হয়ে থাকব।’
এরপর তিনি সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে একে একে হাত মেলান, কোচের সঙ্গে ফিসফিস করে কী যেন বলেন। পরিস্থিতিটা ছিল অদ্ভুত। ভিদেলা পেরুর গোলকিপারকে ঘুষ দিয়েছিলেন—এমন কথাও শোনা গেছে। আবার এ কথাও প্রচলিত আছে, আর্জেন্টিনার জেলে বন্দী থাকা পেরুর ১৩ নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার শর্তে সেই ম্যাচে জয় দাবি করেন ভিদেলা।
তবে ওই বিশ্বকাপের কোনো তদন্ত হয়নি। তাই সঠিক তথ্য ফিফা আজও আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। ভিদেলার চাওয় পূরণ করে সেদিন ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক দানিয়েল পাসারেলা। মেনোত্তি বনে যান আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ।

গত বছরের মে মাসে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন মেনোত্তি। তাঁর সেই দলের ২২ খেলোয়াড়ের মধ্যে তিনজন ওপারে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। ২০১৮ সালের মার্চে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা যান বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য রুবেন গালভান ও রেনে হাউসম্যান। আর এ বছরের ৫ মে না ফেরার দেশে চলে যান লুইস গালভান।
২৫ জুন ১৯৮৩: ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল
লর্ডসের প্যাভিলিয়নে কপিল দেবের হাতে লর্ড কার যখন বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দিচ্ছিলেন, তখন কেমন অনুভূতি হচ্ছিল সেই দলের সদস্য বালবিন্দর সিংয়ের?
কয়েক বছর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক এই পেসার বলেছিলেন, ‘এটা আমার জন্য এক জাদুকরী মুহূর্ত ছিল। আমি এখনো সেই মুহূর্ত অনুভব করি। সেই মুহূর্ত মনে পড়লে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে।’

কপিল দেবের মতে, ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয় নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। স্টার স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই দলের অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমরা যেভাবে এটা (বিশ্বকাপ জয়) করে দেখালাম, তা সত্যিই বিস্ময় জাগিয়েছিল। এটা ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট। এটা ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারাও পাল্টে দিয়েছিল। তখন থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আমরাও ওয়ানডেতে ভালো করতে পারি।’
প্রথম দুই বিশ্বকাপ (১৯৭৫ ও ১৯৭৯) মিলিয়ে মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছিল ভারত। স্বাভাবিকভাবেই তারা ১৯৮৩ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এবার দুটি; বড়জোর তিনটি ম্যাচ জেতা। কিন্তু কপিলের নেতৃত্বাধীন দলটা ধাপে ধাপে সব বাধা পেরিয়ে বিশ্ব জয় করে ফেলল। বিস্ময়কর নয়তো কি!
গ্রুপ পর্ব, সেমিফাইনাল পেরিয়ে ভারত যখন ফাইনালে উঠে গেল, তখনো তাদের বিশ্বকাপ জয়ের কোনো সম্ভাবনা দেখেনি কেউ। শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে প্রতিপক্ষ যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ; বিশ্ব ক্রিকেটে তখন তাদের আধিপত্য, আগের দুই আসরে জিতে এবার তারা হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের অপেক্ষায়।

ফাইনালে শুরুর দিকে কৃষ শ্রীকান্তর ৩৮, মহিন্দর অমরনাথের ২৬ আর লোয়ার অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান মদন লাল, সৈয়দ কিরমানি ও বালবিন্দর সান্ধুর ছোট কিন্তু লড়াকু ইনিংসগুলোতে ভারত যখন ১৮৩ রানে গুটিয়ে গেল, তখনো তো ওয়েস্ট ইন্ডিজই ফেবারিট। গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, ল্যারি গোমেজ…একজন ক্রিজে দাঁড়িয়ে গেলেই যথেষ্ট।
কিন্তু সেদিন মদন লাল, মহিন্দর অমরনাথদের দুর্দান্ত বোলিং আর কপিল দেবের অসাধারণ ফিল্ডিংয়ের সামনে কেউ টিকতে পারেননি। মহাপরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটিয়ে নামায় ভারত; তাদের অলআউট করে দেয় ১৪৩ রানে।
স্টার স্পোর্টসকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারেই কপিল দেব বলেছিলেন, ‘স্বপ্নে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের মুখ দেখে আমার ঘুম ভেঙেছিল। সজাগ হওয়ার পর দেখি আমার পুরো শরীর ঘেমে গেছে। তবে মনে বিশ্বাস ছিল আমরা পারব। আমরা উপভোগের মন্ত্র নিয়েই খেলতে গিয়েছিলাম। ওরা ফাইনাল জিতবে বলেই ধরে নিয়েছিল।’
কপিল দেব বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে এতটাই আশাবাদী ছিলেন যে, পার্টি করার জন্য নিজের ব্যাগে এক বোতল শ্যাম্পেন রেখেছিলেন। তবে উৎসব করার জন্য ভারতীয় দলের বাকিদের কাছে কিছুই ছিল না। এ কারণে তাঁরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন ক্লাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডসদের কাছ থেকে শ্যাম্পেন আনার জন্য।
রেডিফ ডট কমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী দলের উইকেটকিপার কীর্তি আজাদ, ‘(ফাইনাল শেষে) আমরা কয়েকজন শ্যাম্পেন আনতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলাম। ওরা খুব রেগে ছিল। একজন বলল, “এটা নিয়ে এখান থেকে দূর হও।” আমরা ম্যাগনাম শ্যাম্পেনের বিশাল বোতলগুলো ফ্রি পেয়ে গেলাম। সেগুলো দিয়েই উৎসব করলাম।’

ভারতের হয়ে ’৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের ১৪ সদস্যের সবাই জীবিত আছেন। দেশে থাকলে প্রতি বছর ২৫ জুন মুম্বাইয়ে বিসিসিআই কার্যালয়ে তাঁরা একত্র হন। তাঁদের জেতা ট্রফিটা যে সেখানেই রাখা আছে। আজও নিশ্চয় তাঁরা মুম্বাইয়ে মিলিত হবেন; ৪২ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করবেন।
সাহিদ রহমান
ঢাকা