১১ বছর পর সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

0
172
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম

গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে গত মে মাসের মতো মূল্যস্ফীতির এত চাপে পড়েনি সাধারণ মানুষ। গত মাসে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা গত ১৩৪ মাস বা ১১ বছর দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল সোমবার মে মাসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি। ওই বছরের পরের মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য।

বর্তমান মূল্যস্ফীতি বহিরাগত, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছে

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম

দাবদাহ তো আছেই। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ–সংকট। পাশাপাশি বাজারেও আগুন। এতে সীমিত আয়ের মানুষেরা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ রকম এক অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু গত ১ জুন দেওয়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে মে মাসের মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে এক দশকের রেকর্ড মূল্যস্ফীতির তথ্য এল।

গত মে মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালের মে মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনত, চলতি বছরের মে মাসে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা। মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় একধরনের কর, যা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর আরোপ হয়। তবে চাপে পড়ে মূলত সীমিত আয়ের মানুষেরা।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘বর্তমান মূল্যস্ফীতি বহিরাগত, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছে।

কিন্তু সুখের খবর হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে এখন ব্যারেলপ্রতি ৭০-৭৫ ডলারে নেমেছে, যা কোভিডের আগের পর্যায়ে প্রায় চলে আসছে। অন্যান্য পণ্যের দামও কমে আসছে। এসব কম দামের পণ্যের সুফল বাজারে পেতে আরও দুই-তিন মাস সময় লাগবে। তখন মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এ ছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কারণেও পেঁয়াজ, চিনি, আদাসহ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন আবার আমদানি শুরু হয়েছে।’

তাঁর মতে, বাজেটেও সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করা হলেও বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম কমছে। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আমদানিকারকেরা এর জন্য মূলত ডলার-সংকট এবং আমদানির এলসি খোলার ওপর কড়াকড়িকে দায়ী করে থাকেন।

টানা পাঁচ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমে। এরপর কিছুটা বাড়ে, আবার কমে আসে। গত দুই মাস টানা মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তবে গত ১১ মাসে মূল্যস্ফীতি কোনো মাসেই সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি নামেনি।

জুলাই-মে গড় মূল্যস্ফীতি ৮.৮৪%

এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি। সাড়ে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শুরু হয়। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আগস্টে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি একলাফে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ উঠে যায়।

এরপর টানা পাঁচ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমে। এরপর কিছুটা বাড়ে, আবার কমে আসে। গত দুই মাস টানা মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তবে গত ১১ মাসে মূল্যস্ফীতি কোনো মাসেই সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি নামেনি। বিবিএসের হিসাবে, গত ১০ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গ্রাম ও শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় সমান। গ্রামে এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ, শহরে তা ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অবশ্য এর আগে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে উন্নীত না হওয়ায় সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এপ্রিলের শুরুতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। এ সময় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে যায়নি।’

আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার এক বছর ধরেই কম। গত মে মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার হলো ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে।

বিবিএস মে মাস থেকে মূল্যস্ফীতি গণনায় জাতিসংঘের ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব ইনডিভিজুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকোর্ডিং পারপাস বা কইকপ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। সেখানে দেখা গেছে, আবাসন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পরিষেবা; বিনোদন ও সংস্কৃতি; বাসাবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত—এই তিন খাতেই ১১ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। খাবার ও পানীয়—এই দুটি পণ্যে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘উদ্বেগজনক হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রতিফলন নেই। চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করলে তা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। বিবিএসের আনুষ্ঠানিক হিসাবেই এত মূল্যস্ফীতি, তাহলে গরিব মানুষের ওপর আরও বেশি চাপ আছে।’

সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জাতীয় নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। কারণ, অন্য সময় মূল্যস্ফীতি বাড়ে দুই-তিন মাস। এবার এক বছর ধরে এ পরিস্থিতি। মধ্যবিত্তরা এখন হিমশিম খাচ্ছে। বাজারব্যবস্থায় অনিয়ম থাকলে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.