১০০ টাকার গোলাপ কিনে উদ্যোক্তা হওয়া তাসফিয়া এখন প্রশিক্ষক

0
222
গোলাপের পাপড়ির গুঁড়া দিয়ে উদ্যোক্তা জীবনের শুরু হয়েছিল তাসফিয়া আফরোজের। ছবিটি ভারতের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়

তাসফিয়া আফরোজ প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যা শিখেছেন, তার কিছু নমুনা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছেন। ব্যাগ থেকে একে একে বের করলেন বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি দিয়ে বানানো পাখি (নিজে বানিয়েছেন), শসার সাবান, গাঁদা ফুল দিয়ে মশা মারার ওষুধ, গোলাপজল, চন্দ্রমল্লিকা আর গাঁদা ফুল দিয়ে সানস্ক্রিন, ফুল দিয়ে বানানো আগরবাতি, ফুলের তেল, ফেসপ্যাকসহ অন্যান্য জিনিস। নষ্ট বা ফেলে দিতে হবে এমন ফুলের পাপড়ি দিয়ে লকেট, কানের দুল, চাবির রিং, পেপার ওয়েটসহ অন্যান্য জিনিস বানানো যায়, তার নমুনাও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।

সাইকেল চালিয়ে পণ্য কুরিয়ার করতে ছুটছেন তাসফিয়া। করোনার সময় ফেসবুকে ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল

সাইকেল চালিয়ে পণ্য কুরিয়ার করতে ছুটছেন তাসফিয়া। করোনার সময় ফেসবুকে ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

তাসফিয়া বললেন, ‘আমি শুধু ফুলের পাপড়ি গুঁড়া করে তা বিক্রি করেছি। অথচ এই ফুল দিয়েই কত কিছু যে বানানো যায়, তা আমার মাথাতেই ছিল না। শুধু তাই নয়, পূজা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করার পর ওই ফুল দিয়েও যে কত কিছু বানানো যায়, তা–ও শিখে এসেছি। বিবাহবার্ষিকীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বাহারি ফুলের মালা বানানো শিখেছি। সেখানে যাঁদের কাছে শিখেছি, তাঁরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ফুল চাষের সময় যদি কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা না হয়, তাহলে গোলাপ, বেলি, জবাসহ বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি দিয়ে চাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বানানো যাবে।’

প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া ছয়জন নারীর মধ্যে একজন ফুলচাষিও ছিলেন উল্লেখ করে তাসফিয়া বলেন, শুধু অর্গানিক ফুল চাষেও যে ব্যবসার বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো যায়, তা শিখে এসেছেন উদ্যোক্তারা। ফুলচাষিদের সঙ্গে অন্য উদ্যোক্তারা মিলে বড় আকারের ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। তবে তার জন্য বিনিয়োগ লাগবে।

নিজের আর দেখে আসা কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘দেখলাম, সেখানে ফুলের পাপড়ি কাচের ঘরে শুকানো হচ্ছে। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া বা কিছুই করতে হচ্ছে না। আর আমি মাচায় বা চাদরে বিছিয়ে তা শুকাই। বাতাসে উড়ে যায় বলে খেয়াল রাখতে হয়। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জায়গা পাল্টাতে হয়। আমি গুঁড়া করি ছোট ব্লেন্ডারে, সময় বেশি লাগে। আর সেখানে দেখলাম সব কাজ হচ্ছে দ্রুত, দামি দামি মেশিনে।’

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ড. ওয়াইএসআর হর্টিকালচার ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণ নেন তাসফিয়া আফরোজ

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ড. ওয়াইএসআর হর্টিকালচার ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণ নেন তাসফিয়া আফরোজ 
ছবি: সংগৃহীত

২৪ বছর বয়সী তাসফিয়া আফরোজ বললেন, ‘স্বপ্নের পরিসর বড় হয়েছে, তবে পুঁজি তো নেই। পুঁজি থাকলে যা শিখে এসেছি তা কাজে লাগাতে পারব। এত দিন বলতে গেলে তেমন কিছু না শিখেই কাজ করতাম, এখন অনেক কিছু হাতে–কলমে শিখে এসেছি।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট-১–এর প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, যে ছয়জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরলেন, তাঁরা অন্য উদ্যোক্তাদের তা শেখাবেন। আর বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসাদের মধ্যে কেউ ভালো কাজ দেখাতে পারলে তাঁরা নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নিলে তাতে মেশিনসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়া হবে। তবে নতুন প্রকল্পটি দলভিত্তিক হলে তা অগ্রাধিকার পাবে। এ ছাড়া প্রকল্পের উদ্যোক্তাদেরও প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।

উদ্যোক্তাজীবনের শুরু

২০২১ সালের ১ জুলাই তাসফিয়া আফরোজের উদ্যোক্তাজীবন নিয়ে ‘শুকনা গোলাপ পাপড়িতে সতেজ জীবন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এখন গাজীপুরের সরকারি টঙ্গী কলেজের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী তাসফিয়া। জানালেন, কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করা, খণ্ডকালীন চাকরিসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ২০২০ সালে করোনায় সব বন্ধ হয়ে যায়। তারপর অনেকটা বাধ্য হয়েই শুরু হয় তাঁর উদ্যোক্তাজীবন।

মায়ের কাছে সব মিলে সংসারের বাজার খরচ ছিল ১৫৫ টাকা। সাহস করে সেখান থেকেই ১০০ টাকা নিয়ে ১০০ গোলাপ ফুল কিনে নতুন উদ্যোগ শুরু করা তাসফিয়া এখন হাজার হাজার গোলাপ ফুল কিনে তা শুকিয়ে তার গুঁড়া বানান। এরই মধ্যে উদ্যোক্তাদের ফেসবুক গ্রুপ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছেন বেশ।

তাসফিয়া জানালেন, এ উদ্যোগের কারণে গ্রামের অনেকের এখন আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। তাঁর ভাষ্য,  ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে আশপাশের বাড়ি থেকে নিম, শজনে, মেহেদির পাতাসহ বিভিন্ন পাতা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে গুঁড়া করতেন। এ নিয়ে মানুষজন হাসাহাসিও করতেন। ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকলে তিনি এসব পাতা বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে কিনতে চাইলেন। এতেও মানুষ প্রথমে লজ্জা পেতেন যে, গাছের পাতা আবার বিক্রি হয় নাকি? তবে এখন তাঁরা পাতা বিক্রি করেই মাসে আয় করছেন।

প্রশিক্ষণে শিখেছেন শসা থেকে সাবার, ফুলের পাপড়ি দিয়ে চাবির রিং তৈরি

প্রশিক্ষণে শিখেছেন শসা থেকে সাবার, ফুলের পাপড়ি দিয়ে চাবির রিং তৈরি

তাসফিয়া আফরোজ বললেন, ‘প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যা শিখে এসেছি, ব্যবসা মন্দার সময়গুলোতে তা নিয়ে কাজ করতে পারব।’

মা মনোয়ারা বেগমের অবদানের কথা বলতে গিয়ে তাসফিয়া বললেন, ‘মা আমার ব্যবসার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। নিজে গোলাপ কিনে তা গুঁড়া করে দেন। আমার গায়ের রং ফরসা না, তাই মা ডাল, গোলাপ পাপড়ি শুকিয়ে গুঁড়া করে দিতেন। হোস্টেলে সেগুলো অন্যরা খুব পছন্দ করতেন। নারীদের বিভিন্ন গ্রুপে এগুলো শেখাতাম, তারপরও গ্রুপের অনেকেই তা কিনতে চাইতেন। সব মিলেই আসলে এগুলো নিয়ে ব্যবসা শুরু করার সাহসটা পেয়েছিলাম।’

তাসফিয়া আফরোজের বাবা মো. আবুল হোসেনের শিঙাড়া, সমুচার দোকান ছিল। অসুস্থতার কারণে ২০২০ সাল থেকে সেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ২০২১ সালে বোন জেসিয়া তাঁর (তাসপিয়া) পণ্য ডেলিভারির জন্য বের হয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এখন অসুস্থ মা-বাবা, দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া বোন, সাত বছরের মামাতো ভাই ও নানি সবার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। প্রায় আড়াই বছর আগে তাসফিয়া বিয়ে করেছেন। তবে তিনি থাকছেন নানিবাড়িতেই। তবে তাঁর ব্যবসায় স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা মানসিকভাবে তাঁকে অনেক সমর্থন দেওয়ায় তিনি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, ‘এ কারণেই স্বাধীনভাবে ব্যবসাটি করে যেতে পারছি।’

করোনার সময় সাইকেল চালিয়ে পণ্য কুরিয়ার করতে ছুটছেন, ফেসবুকে তাসফিয়া নিজের এমন একটি ছবি শেয়ার করলে তা ভাইরাল হয়েছিল। তাসফিয়া বলেন, পথ এখনো অনেক বাকি। যেতে হবে বহুদূর।

মানসুরা হোসাইন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.