১০ বছরেও বিচারে অগ্রগতি সামান্যই

0
144
রানা প্লাজা ধস
  • রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়
  • খুনের মামলায় ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ
  • স্থগিতাদেশের কারণে খুনের মামলার বিচারকাজ বন্ধ ছিল ৫ বছর
  • খুনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির

    সাভারের বহুল আলোচিত রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী ২৪ এপ্রিল। কিন্তু এত দিনেও ১ হাজার ১৩৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় করা খুনের মামলার বিচারকাজ বেশি দূর এগোয়নি। ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা বলছেন, মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

    খুনের মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে গত বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, কয়েকজন আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় দীর্ঘদিন খুনের মামলায় বিচারকাজ বন্ধ ছিল। তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

    ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন নিহত ও ১ হাজার ১৬৯ জন গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলাটি করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অন্য দুটি মামলা করে। কোনো মামলারই বিচার শেষ হয়নি।

    স্থগিতাদেশে আটকে ছিল পাঁচ বছর

    রানা প্লাজা ধস
    রানা প্লাজা ধসফাইল ছবি

    মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, খুনের মামলার তদন্তে সময় লেগেছে দুই বছর। ছয় সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার ক্ষেত্রে অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করতে দেরি হয়। জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত করার অনুমতি দেবে না তারা। তবে অনুমোদন না পেলেও তাঁদের আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর মামলার বিচার শুরুর আদেশ হয় আরও এক বছর পর।

    তবে বিচার শুরুর আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলার সাত আসামি উচ্চ আদালতে গেলে তাঁদের পক্ষে বিচারকাজে স্থগিতাদেশ আসে। এ কারণে পাঁচ বছর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আগামী ১৪ মে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

    রানা প্লাজা ধস
    রানা প্লাজা ধস

    গত মঙ্গলবার ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) বিমল সমাদ্দার বলেন, মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে সমন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে। তবে অনেক সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে পুলিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যাঁরা আসছেন, তাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে।

    অভিযোগপত্রভুক্ত দুজন আসামি মারা যাওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আসামি ৩৯ জন। তাঁদের মধ্যে রানা প্লাজার মালিকের ছেলে সোহেল রানা কারাগারে। এ ছাড়া ৭ আসামি পলাতক ও বাকি ৩১ আসামি জামিনে আছেন।
    অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়।

    তখন বিজিএমইএর কর্মকর্তারা ভবন পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত ভবন বন্ধ রাখতে পোশাক কারখানার মালিকদের পরামর্শ দেন। কিন্তু পাঁচ পোশাক কারখানার মালিক, ভবনমালিক ও তাঁদের লোকজন ভয় দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল পোশাককর্মীদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। ভবনের মালিক আবদুল খালেকের ছেলে সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’

    অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, রানা প্লাজা তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন ভবনটির মালিক ও তাঁর ছেলে। ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দিলেও ভবন খালি করা হয়নি। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। এ সময় বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে।

    ভুক্তভোগী শ্রমিক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সোহেল রানাসহ অন্যদের কারণে সেদিন আমাদের কত ভাই-বোনের করুণ মৃত্যু হয়েছিল। আমার মতো শত শত শ্রমিক পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। কিন্তু যাঁদের অপরাধে আমাদের ভাই-বোনের জীবন গেল, আমরা পঙ্গু হলাম; ১০ বছর পরও তাঁদের শাস্তি হলো না। এর চেয়ে খারাপ উদাহরণ আর কী হতে পারে।’

    ইমারত আইনে বিচারে অগ্রগতি নেই

    মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, রানা প্লাজা ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। ২০১৬ সালের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তবে ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি রিভিশন আবেদন করেন।

    রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বলেন, কয়েকজন আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ রয়েছে।

    এ ছাড়া ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। ২০১৭ সালের ২১ মে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।

    মামলার বিচার নিয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, করোনার কারণে দুই থেকে তিন বছর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণে ধীর গতি ছিল। তবে এখন সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।

    ১০ বছরেও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন নারী অধিকারকর্মী তসলিমা আখতার। তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে। আর রানা প্লাজার মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার মধ্য দিয়ে বিচারহীনতা ও গণতন্ত্রহীনতার বিষয়টি সামনে আসছে বারবার। আমরা আশা করি, রাষ্ট্রপক্ষ রানা প্লাজার মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’

    আশা রাষ্ট্রপক্ষের

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.