শাহাদাত হোসেনের দোকানের সামনেই দেখা হয় ষাটোর্ধ্ব ইউনুস আলীর সঙ্গে। দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে বলছেন ১০ টাকার গরুর মাংস আর একটি ডিম দিতে। বলামাত্রই ফ্রিজ খুলে মাংসের ছোট্ট প্যাকেট বের করে হাতে তুলে দিলেন শাহাদাত, সঙ্গে ডিমও।
ইউনুস আলী জানালেন, ‘নাতির জন্য নুডলস রান্না করবেন, তাই মাংস আর ডিম নিতে আসছি। একটু মাংস দিলে নুডলস মজা হয় আর নাতিও পছন্দ করে খেতে।’ ইউনুস আলী বলেন, প্রায়ই ১০, ৫০ বা ১০০ টাকার গরুর মাংস কেনেন যখন যেমন প্রয়োজন।
বিকেলের দিকে শাহাদাতের দোকানে দুই পদের মাছ আর ব্রয়লার মুরগির মাংস কিনতে আসেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুমন। তিনি ৭৫ টাকায় রুই মাছ ৩ টুকরা, ২৫ টাকায় এক টুকরা পাঙাশ মাছ আর ৫৬ টাকায় ব্রয়লার মুরগির রানের ১ টুকরা মাংস কেনেন। সব মিলিয়ে তাঁর খরচ ১৫৬ টাকা।
সুমন জানান, ‘স্বল্প আয়ের সংসারে সব সময় একসঙ্গে দুই রকমের বড় মাছ কেনা যায় না, আর কয়দিন হলো তো মুরগির যে দাম বাড়ছে। তার চেয়ে এখান থেকেই ইচ্ছামতো বাজার করি। বাচ্চার জন্য মুরগি আর পাঙাশ মাছ নিলাম। ওর মা আর আমার জন্য রুই মাছ। পরিবারে মানুষ কম, তাই যখন যেমন টাকা থাকে, তেমন বাজার করি। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট।’
মাছ, মাংসের সঙ্গে ১০ টাকার সয়াবিন তেল দুই প্যাকেট আর ৫ টাকার কাঁচা মরিচ কিনে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে আবারও ফিরে এলেন সুমন। তাঁর মনে হয়েছে গরমে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ৫ টাকার কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া যায়।
‘মাত্র ১০০ টাকায় যেখানে কিছুই বাজার করা যায় না, আমার দোকানে সেখানে এই টাকায় দুজন মানুষ এক বেলা পরিপূর্ণ খেতে পারে, এমন বাজার করা যায়। পরিপূর্ণ আমিষসহ।’ বলছিলেন শাহাদাত হোসেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এভাবে পণ্য বিক্রি করা কীভাবে সম্ভব, জানতে চাই তাঁর কাছে। শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘কোনো জিনিসের দাম বাড়তে পারে কিন্তু কেউ যদি তার সাধ্যমতো কিনতে চায় তবে কিন্তু তার পরিমাপ আছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজারব্যবস্থায় মানুষ তার প্রয়োজনমতো কিনতে পারে না। আমি যত দিন ধরে ব্যবসা করি, আমি অনুভব করি মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করে মুদিদোকানে এলে। তারা চাইলেই পারে না তাদের চাহিদামতো জিনিস কেনাকাটা করতে। তাই সেখান থেকেই আমার চিন্তাধারাটা এমন ছিল জিনিসের দাম যতই বাড়ুক, অল্প পরিমাণে হলেও যদি আমি ওজন মেপে ক্রেতাকে দিতে পারি তাহলে তার পরিপূর্ণ তৃপ্তি না হলেও স্বাদ কিন্তু নিতে পারবে।’ এভাবে ব্যবসা করলেও ক্ষতি নেই বলে জানান তিনি। তার ওপর এভাবে ব্যবসাকে সেবা হিসেবেও দেখেন শাহাদত।
শাহাদাত হোসেনের পাটোয়ারী স্টোরে আধা কেজি চালের প্যাকেট পাওয়া যায়। ৫ পিছ পেঁয়াজ, বড় দুই কোয়া রসুন আর এক টুকরো আদা এক প্যাকেটে বিক্রি করেন ১০ টাকায়। এ ছাড়া ছয় রকমের ডাল দিয়ে আছে ৩০ টাকার প্যাকেট। যার সঙ্গে চাল মিশিয়ে রান্না করা যাবে খিচুড়ি। ছোট শিশুদের জন্য চাল, ডাল আর মসলা একসঙ্গে প্যাকেট পাওয়া যায়, যা বাসায় নিয়ে সরাসরি রান্না করে খাওয়ানো যাবে।
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেক সময় শুনতে পাই মানুষ বছরে একবার কোরবানির ঈদের সময় গরুর মাংস খাইছে বা অনেক দিন ধরে বড় মাছও কিনতে পারে না। আবার সবজির দামও ওঠানামা করে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সব একবারে কেনা সম্ভব হয় না কখনো। কিন্তু আমি চিন্তা করি, যদি অল্প করে বিক্রি করি তাহলে মানুষ তাদের সাধ্যের মধ্যে একদিন রুই মাছ, একদিন ইলিশ মাছ আবার একদিন চিংড়ি মাছ, কোনো দিন গরুর মাংস, কোনো দিন মুরগির মাংস খাইতে পারে। এতে কারও মাঝে কোনো আফসোস থাকে না।’
পাটোয়ারী স্টোরের সামনে শক্ত কাগজের ওপর হাতে লেখা আছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। কোথাও লেখা, প্রয়োজন যতটুকু, কিনবেন ততটুকু। শাহাদাত হোসেনের দোকানটি এলাকার শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কারণ, এ দোকান থেকে মাত্র ৫ টাকায় পাওয়া যায় নানা ঠান্ডা পানীয়। যেগুলো অন্য সব দোকানে লিটার বোতলে বিক্রি হয়।
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘বাচ্চাগুলোর বাবাদের আয়–উপার্জন আর কত। কিন্তু তাঁরা তো চাইলেই সন্তানদের ২৫ টাকা বা ৩০ টাকা দিয়ে এসব বোতল কিনে দিতে পারেন না। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই বোতল খুলে আমি ৫ টাকা গ্লাস সেসব বিক্রি করি।’ ১৬ বছর ধরে মুদিদোকানের ব্যবসা করলেও সাড়ে তিন বছর ধরে এভাবেই বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছেন তিনি।
আসছে পবিত্র রমজান মাস। এ মাসের কথা মাথায় রেখে নানা ফল দোকানে তুলেছেন তিনি। তাঁর দোকানে পুরো একটি মাল্টার দাম ৩০-৩৫ টাকা আর প্রতি টুকরা কাটা মাল্টা বিক্রি হয় ৫ টাকায়। তবে কাটা কমলার টুকরা, বরই, আঙুর, কাটা মাল্টা এক প্যাকেটে ‘মিক্স ফ্রুট’ হিসেবে বিক্রি করেন তিনি। দাম ৫ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে।