যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। তবে শুধু এই পরিচয়ে তাঁকে বেঁধে ফেলা কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়ে মার্কিন কূটনীতির অন্যতম প্রতীক ধরা হয় তাঁকে। কাজ করেছেন দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে। সফলতা আর সমালোচনা যেন পাল্লা দিয়ে তাঁকে ঘিরে রেখেছিল, রেখেছে।
বলা হয়, মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কুখ্যাত’ যুদ্ধাপরাধী কিসিঞ্জার। অথচ বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ-সংঘাতের ‘কারিগর’ কিসিঞ্জারকে কখনো সেভাবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। উল্টো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এ নিয়েও চরম বিতর্কের মুখে পড়ে নোবেল কমিটি। সমালোচিত হন কিসিঞ্জার।
আলোচিত-সমালোচিত কিসিঞ্জার স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর।
শতবর্ষে এসেও বেশ সক্রিয় ছিলেন কিসিঞ্জার। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের বৈঠকে দেখা গেছে তাঁকে। নেতৃত্বের ধরন নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি নিয়ে মার্কিন সিনেটের মুখোমুখি হয়েছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, গত জুলাইয়ে তিনি আকস্মিক সফরে চীনের বেইজিং যান। বৈঠক করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গেও।
রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ড—এ দুই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, ইসরায়েল ও প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করায় কিসিঞ্জারের ভূমিকা ছিল।
এ ছাড়া কম্বোডিয়া ও লাওসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সম্প্রসারণ ও পরবর্তী সময় যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ, আর্জেন্টিনা ও চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন, ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার রক্তক্ষয়ী অভিযানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক নৃশংসতার বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখা—এসব নিয়ে বেশ আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন তিনি।
অভিবাসী থেকে ক্ষমতাবৃত্তে
কিসিঞ্জারের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৭ মে, জার্মানির ফোর্থ শহরে। পুরো নাম হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে জার্মানি ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন কিশোর কিসিঞ্জার। তখনো ইউরোপবাসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মুখে পড়েনি। হিটলারের নাৎসিদের হাতে ব্যাপক ইহুদি নির্যাতন শুরু হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে এসে নামের ইংরেজি অংশ ‘হেনরি’ জুড়ে নেন কিসিঞ্জার। ১৯৪২ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পান তিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে স্নাতকোত্তর ও ১৯৫৪ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। পরের ১৭ বছর কিসিঞ্জার হার্ভার্ডে শিক্ষকতা করেছেন। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে ইউরোপের রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন।
এই সময়টায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পরামর্শকের কাজ করেছেন কিসিঞ্জার। পরে যুক্ত হন পররাষ্ট্র দপ্তরে। কাজ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জনসন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ডামাডোলে ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। তিনি কিসিঞ্জারকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে বসান।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত বিষয়। এর অন্যতম রূপকার কিসিঞ্জার। যুদ্ধকে লাওস ও কম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন তিনি। ভিয়েতনাম নিয়ে শান্তি উদ্যোগের মধ্যমণিও তিনি। ১৯৭২ সালে কিসিঞ্জার বলেন, ‘শান্তির উদ্যোগ হাতের মুঠোয় রয়েছে।’ পরের বছর সই হয় প্যারিস শান্তি চুক্তি।
নোবেল নিয়ে বিতর্ক
১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জারের সফলতার মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। একই বছর লি ডাক থোর সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পান তিনি। ভিয়েতনামে যুদ্ধের রাশ টানা এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে নোবেল কমিটি। প্রতিবাদ জানিয়ে কমিটির দুই সদস্য পদত্যাগ করেন।
সমসাময়িক সময়ে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও সেখানে মার্কিন প্রভাব বাড়ানোতে ভূমিকা রাখেন কিসিঞ্জার। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ছুটে যান চীনে। বেইজিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সূচনা করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। এর জেরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঐতিহাসিক সফরে বেইজিং যান। চীনের নেতা মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিতর্ক ছাপিয়ে টিকে থাকা
তত দিনে বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচিত-সমালোচিত এক নাম হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন রাজনীতিও উত্তাল হয়ে উঠেছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে। পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। ১৯৭৪ সালে ক্ষমতা নেন জেরাল্ড ফোর্ড। তাঁর প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কিসিঞ্জার।
একই বছর প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্লাদিভোস্তকে যান কিসিঞ্জার। সেখানে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে বৈঠক হয় তাঁদের। কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে সম্মত হয় দুই দেশ। স্নায়ুযুদ্ধে উত্তাল ওই সময়ে এটা ছিল বড় একটি অর্জন।
তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যর্থতার স্বাদ পান কিসিঞ্জার। চিলি ও আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন করেন তিনি। লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় বামপন্থী নেতাদের হত্যার পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার রক্তক্ষয়ী অভিযানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সমালোচিত হন তিনি। তবে এসব তাঁর অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারেনি।
‘সুপার পররাষ্ট্রমন্ত্রী’
নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের দহরম-মহরম এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে রুশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ দার্শনিক ইসাইয়া বার্লিন তাঁদের ‘নিক্সনজার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই ‘জুটি’ ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে। উদারনৈতিক এলিটদের অবজ্ঞা করা ছিল তাঁদের লক্ষ্য।
প্রেসিডেন্ট ফোর্ড হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিলে প্রভাব কমতে শুরু করে কিসিঞ্জারের। পরবর্তী সময় প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও রোনাল্ড রিগ্যান তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন। ক্ষমতাবৃত্ত থেকে সরে এসে কিসিঞ্জার প্রভাবশালী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানেও সফলতা পান তিনি।
কিসিঞ্জার একজন দক্ষ কূটনীতিক ছিলেন। রাজনীতি ও কূটনীতির মারপ্যাঁচ বেশ ভালো বুঝতেন। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তাঁকে ‘সুপার পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় সমালোচকেরা বলেন, কিসিঞ্জারের মধ্যে একধরনের প্রবল অহংবোধ (ইগো) ছিল। কিসিঞ্জার মনে করতেন, তিনি কখনোই ভুল করেননি।