ড্যানিয়েল ওয়াল্ডম্যান ৭ অক্টোবর ভোরের কিছু আগে জীবনে শেষবার নেচেছিলেন। এরপরই প্রাণ বাঁচাতে বন্ধুদের নিয়ে ছুটে বেড়ান। আর কখনো বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁদের।
তাঁদের সঙ্গে কী ঘটেছিল, তার কিছু নমুনা পাওয়া গেছে ছোট একটি ভিডিওতে। একটি ফোনে ভিডিওটি রেকর্ড করা হয়েছিল। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তার সামান্য ধারণা পাওয়া গেছে ওই ভিডিওতে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ২৪ বছর বয়সী ড্যানিয়েল ওয়াল্ডম্যান দুজন বন্ধুর সঙ্গে গাড়ির পেছনের আসনে বসে আছেন। তাঁরা সবাই মৃদু হাসছিলেন এবং কথার পিঠে কথা বলতে শোনা যায়। কিছুক্ষণ আগে সংগীত উৎসব থেকে ফেরায় কবজিতে নীল রঙের কাগজও দেখা গেছে।
তাঁরা শান্ত থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ শিকারি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তাঁদের। ড্যানিয়েলের বন্ধু নোয়াম সাই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। ‘তোমরা কি চাও আমি কি আরও জোরে গাড়ি চালাই?’ তাঁকে প্রশ্ন করতে শোনা যায়। পরক্ষণে নিজেই বলেন, ‘আমি জানি কীভাবে জোরে গাড়ি চালাতে হয়।’
‘ঠিক’, নারী কণ্ঠে একজনকে বলতে শোনা যায়। এ সময় ড্যানিয়েলের পাশের আসনে থাকা দাড়িওয়ালা এক তরুণ সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছুই হবে না। সবকিছু ঠিক আছে, তা–ই না?’
এরপরই সামনের আসন থেকে উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন ‘ডানে যাব না বাঁয়ে?’ এরপরই ভিডিওটি শেষ হয়ে যা
এর কয়েক মিনিট পরে হামাস যোদ্ধাদের গুলিতে গাড়িটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মেরে ফেলা হয় নোয়াম, ড্যানিয়েল ও তাঁদের বন্ধুদের। অপহরণ করা হয় সামনের আসনে থাকা যাত্রীকে। ওই দিন হামাস সদস্যদের হাতে নিহত হন আরও ৩৬০ ইসরায়েলি। তাঁরাও গাজা সীমান্তের কাছে নেগেভ মরুভূমিতে সংগীত উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ওই দিন হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। তাঁদের মধ্যে সংগীত উৎসবে যোগ দিতে আসা ব্যক্তি ও সীমান্তবর্তী কিব্বুত এলাকার বাসিন্দারাও ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইহুদি নিধনের ঘটনার পর এক দিনে সবচেয়ে বেশি ইহুদি নিহত হন ওই দিন। যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
এরপর ওই দিন থেকে গাজায় ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। হামাস নির্মূলের নামে ফিলিস্তিনি নিধনে নামে দেশটির সেনাবাহিনী। গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ১৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৭ হাজার ৩০০ শিশু।
তেল আবিবে ড্যানিয়েলের বাবা ইয়েলের সঙ্গে কথা হয় বিবিসির সাংবাদিকের। তাঁর অফিসটি শিল্পকর্মে ঠাসা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তি খাতের বড় ব্যবসায়ী। মেলানক্স টেকনোলজি নামে একটি চিপ তৈরির প্রতিষ্ঠান ছিল তাঁর। ২০১৯ সালে ৬৮০ কোটি ডলারে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেন। কিন্তু এখন তিনি শুধুই একজন নিঃস্ব বাবা। ছোট মেয়েকে হারিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় তাঁদের।
কষ্ট আর ভালোবাসা মিশ্রিত কণ্ঠে মেয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ইয়েল বলেন, ‘সে অসাধারণ মেয়ে ছিল। সে নাচতে ভালোবাসত। প্রাণীদের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা ছিল। সে মানুষকে ভালোবাসত। তাঁর অনেক বন্ধু ছিল।’
মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না, ইয়েলের কাছে যখন এই খবর আসে, তখন তিনি ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন। ওই সময় ইসরায়েলের আকাশে বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও তাঁকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়।
বিমান থেকে নামার তিন ঘণ্টা পরই মেয়েকে খুঁজতে বের হন ইয়েল। অ্যাপল ঘড়ির সংকেত ব্যবহার করে মেয়েকে খুঁজতে বের হন, যা তাঁকে যুদ্ধের মাঠে নিয়ে যায়।
ইয়েল বলেন, ‘তিনজন অফিসারকে নিয়ে একটি জিপে চড়ে দক্ষিণ দিকে এগোতে থাকি।’ সেখানে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া গাড়ির দেখা মেলে। কিন্তু ড্যানিয়েলের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
ইয়েল আরও বলেন, ‘গাড়িটির ভেতর ছিল রক্তাক্ত। আশা করেছিলেন সে (ড্যানিয়েল) এই গাড়িতে ছিল না। অথবা আহত হলেও পালাতে সক্ষম হয়েছে কিংবা তাকে জিম্মি করা হয়েছে।’ কিন্তু দুদিন পর ড্যানিয়েলের মরদেহ পাওয়া যায়।
নৃশংসভাবে ছোট মেয়েকে হত্যা করা হলেও ইয়েল ওয়াল্ডম্যান এখনো বিশ্বাস করেন, ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্র থাকা দরকার এবং সেটা শিগগিরই।
ইয়েল বলেন, ‘দুই পক্ষের নেতৃত্বেই পরিবর্তন আনা দরকার। তাহলে দুই থেকে চার বছরের মধ্যে আমরা শান্তি ফেরাতে পারব বলে আমি আশাবাদী। এর মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের জন্য এমন দুটি রাষ্ট্র গঠন করা যাবে, যারা মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করবে।’
তবে এর আগে ইয়েল চান, ৭ অক্টোবরের ঘটনার জন্য যাঁরা দায়ী ও জড়িত ছিলেন, তাঁদের নিশ্চিহ্ন করা হোক। এটা করতেই হবে।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা যুদ্ধের বিভীষিকা সম্পর্কে ভালো জানেন। তিনি একসময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চৌকস শাখা, দ্য গোলানি ব্রিগেডে ছিলেন।
বেশ কিছুদিন আগে গাজায় একটি নকশাকেন্দ্র খুলেছিলেন ইয়েল। সেখানকার একটি হাসপাতালে সাড়ে ৩ লাখ ডলারের বেশি দান করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
এ জন্য তিনি অনুশোচনায় ভুগছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়েল নির্দ্বিধায় বলেন, ‘না, আমার অনুশোচনা হয়নি। আমি মনে করি, এই জায়গাটিকে বসবাসের জন্য সব ধরনের উপযোগী করতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত’।
ইয়েল আরও বলেন, ‘একে অপরকে হত্যা বন্ধ করা দরকার বলে আমি মনে করি। সেই সঙ্গে মিলে মিলে বসবাস করারও একটি উপায় খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আমি অন্তত আড়াই দশক ধরে শান্তির জন্য কাজ করছি।’
বিবিসি