চার বছর আগে খুন হয়েছিলেন মোসাম্মৎ আয়না। গাজীপুর থানা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত চালিয়ে গেলেও খুনের রহস্য ভেদ করতে পারেনি পুরোপুরি। বছরখানেক আগে পাঁচজনকে আসামি করে অভিযোগপত্রও দিয়েছিল পিবিআই। তবে বাদীপক্ষ আদালতে নারাজি দেওয়ার পর ওই মামলার পুনঃতদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এতে হত্যার রহস্য বেরিয়ে এসেছে।
কারাগারেই আয়না হত্যার ছক চূড়ান্ত হয়েছিল। স্বামী দিদার আহমেদ ও তার ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত আলী হোসেন ছিল প্রধান পরিকল্পনাকারী। গাজীপুরের গাছা থানা এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি এই আলী হোসেন। আর মাদক কারবারে তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করত দিদার। পাশাপাশি সে পুলিশের সোর্সও ছিল। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ‘গুরু-শিষ্য’ দু’জনই ২০১৮ সালে কারাগারে যায়। আয়না তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল– এ ক্ষোভ থেকে জেল থেকে বের হওয়ার পর তাঁকে শায়েস্তা করার অঙ্গীকার করেছিল দুই কারাবন্দি। ২০১৯ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পরপরই পরিকল্পনামাফিক আয়নাকে হত্যা করা হয়।
এর পর চার বছর পরিচয় লুকিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মাজারে মাজারে ঘুরত আয়নার স্বামী দিদার। রাত-দিন মাজারেই কাটাত। এ বছরের শুরুতে ঢাকায় নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি নেয় সে। পরে সোর্স নিয়োগ করে সিআইডি আয়নার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে। এর পর সে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সব মিলিয়ে হত্যা মিশনে ছিল ১০ জন। এ সপ্তাহেই এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা রয়েছে।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গাজীপুরের গাছার খাইকুল এলাকার আইয়ুব সরকারের মেয়ে আয়নাকে ২০১৮ সালে বিয়ে করে দিদার। বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে তাদের মধ্যে কলহ দেখা দেয়।আয়নার স্বামী দীর্ঘদিন মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকায় সংসারে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। বিয়ের পরের বছর সন্তান হলেও দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক হয়নি। এরই মধ্যে মাদক মামলায় কারাগারে যায় দিদার ও আলী। গাছা এলাকায় আলীর মাদক চক্রের প্রায় পুরোটাই দেখভাল করত দিদার। পুলিশের সোর্স হওয়ায় তার পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ ছিল। তবে তারা একসঙ্গে জেলে যাওয়ার পর সব হিসাব বদলে যায়। তারা বিশ্বাস করতে থাকে, তাদের পরিণতির জন্য দায়ী দিদাদের স্ত্রী। স্বামী জেলে যাওয়ার পর ছোট্ট সন্তানসহ বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন আয়না। তবে আলীর পরামর্শে জেল থেকে বের হয়ে স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিতে সব আয়োজন চূড়ান্ত করে দিদার। শ্বশুরের বাড়িতে নিজে না গিয়ে ফোনে স্ত্রীকে কারামুক্তির খবর দেয়। এও বলে, ‘এখন থেকে ভালো হয়ে যাবে। মাদকের লাইন ছেড়ে দেবে।’
স্ত্রীও তার কথায় বিশ্বাস করতে থাকেন। এর পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাদিমকে পাঠিয়ে স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই দুপুরে আয়না আসার পর গাছা এলাকায় নানা জায়গায় দিদার তাকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে নেওয়ার কথা বলে আয়নাকে দিদার বলে, ‘এতদিন পর জেলখানা থেকে বের হলাম। দুইজনে ঘোরাঘুরি করে তার পর বাড়ি ফিরব।’
ওইদিন সন্ধ্যায় গাছার দক্ষিণ খাইকুল এলাকার মফিজুল হকের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে জোর করে ইয়াবা সেবন করায়। এরই মধ্যে ওই বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় আলী হোসেন ও তার কয়েকজন সহযোগী। আয়নার সামনেই পরিত্যক্ত ভবনে মাদকের আসর বসানো হয়। রাত ১০টার দিকে দিদার ও আয়নাকে রেখে একে একে সবাই পরিত্যক্ত ভবন থেকে বের হয়। তারা ওই ভবনের সামনে পাহারা বসায়।
সবাই চলে যাওয়ার পর দিদার তার স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চায়, ‘কেন কৌশলে তাদের কারাগারে ঢোকানো হলো?’ তবে স্বামীর আনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন আয়না। তখন দিদার ক্ষুব্ধ হয়ে গলায় থাকা ওড়না পেঁচিয়ে স্ত্রীকে হত্যা করে। এর পর বাড়ির বাইরে পাহারায় থাকা আলীসহ অন্যদের বিষয়টি জানায়। তখন সবাই আবার পরিত্যক্ত ভবনে ঢোকে। আয়নার চুল কেটে দেয় আলী হোসেন। কাঁচি তার চোখের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় সে। লাশ সেখানে রেখে যে যার মতো পালিয়ে যায়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মো. খালেক জানান, হত্যার পর কৌশল করে আলী হোসেন দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। তার লোকজনের মাধ্যমে আয়নার পরিবারকে জানায়, খুনের সঙ্গে জড়িত দিদার। সে এর কিছু জানে না। ঘটনার পর আয়নার স্বামী পালিয়ে গেছে।
সিআইডি বলছে, আয়না হত্যার সঙ্গে ১০ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা হলো– দিদার, আলী, আরিফ ওরফে পাকিস্তানি আরিফ, বিজয়, শুভ, রাকিব, মুন্না, ইকবাল, আলমগীর ও নাদিম। তাদের মধ্যে রাকিব এখনও পলাতক। বাকিদের গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
আসামিদের মধ্যে নাদিম ও দিদার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের সোর্স থাকায় কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়, তা জানা ছিল দিদারের। স্ত্রী হত্যার পরপরই সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মাজারে ঘুরে বেড়িয়ে সেখানেই রাত কাটাত। মোবাইল ফোনও ব্যবহার করত না। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর রক্ষা হয়নি।