রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহত হওয়ার ঘটনার পর দেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংকের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এ ব্যাংকের অবস্থান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাইলস্টোনের ঘটনার পর অনেকেই স্কিন (চামড়া বা ত্বক) দান করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করছেন। স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্বক থাকলে ৪০ শতাংশের বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীকেও বাঁচানো সম্ভব।
২১ জুলাই দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। গত সোমবার রাত ১০টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ৩৪ জন মারা গেছে। আর সোমবার বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৪৫ জন। তাদের মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৩৩ জন।
দেশে স্কিন ব্যাংকের যাত্রা শুরুর পর দান করা ত্বক ব্যবহার করে ১০ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই বেঁচে গেছেন। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকায় একজন মারা গেছেন।
জীবিত ব্যক্তির শরীর থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা ত্বক মারাত্মকভাবে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া যে কেউ চাইলে মরণোত্তর ত্বক দান করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দাতার মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মরদেহ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই ত্বক দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
ওজন কমানোসহ কিছু প্লাস্টিক সার্জারির পর বেঁচে যাওয়া ত্বক সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে দেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে। আগে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের পর বাড়তি ত্বক ফেলে দেওয়া হতো।
স্কিন ব্যাংকের সমন্বয়কারী ও জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব হাসান বলেন, মাইলস্টোনের ঘটনার পর ত্বকদানের বিষয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে; বিশেষত অনেক নারী আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে যোগাযোগ করেছেন।
তবে সমস্যা হলো, আগ্রহী ব্যক্তিদের বেশির ভাগ চাইছেন, মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের শরীরে যাতে তাঁদের দান করা ত্বক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে প্রক্রিয়া শেষে কার দান করা ত্বক কার শরীরে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ত্বক দান করার ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংসহ পুরো প্রক্রিয়া শুনে অনেকে আর আগ্রহ দেখাননি। এখন পর্যন্ত যাঁরা যোগাযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ জন ত্বক দান করতে চেয়েছেন বলে জানান চিকিৎসক মাহবুব হাসান।
ভবিষ্যতে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় ত্বক সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। ত্বক সংগ্রহের পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে সেই ত্বক পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
৩ জুলাই মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম আন্তর্জাতিক দগ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্তদের সম্মেলন। এই সম্মেলনে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ফার্স্ট স্কিন ব্যাংক ইন বাংলাদেশ: দ্য ওয়ে অব ওভার কামিং দ্য চ্যালেঞ্জেস’ শিরোনামের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাহবুব হাসান। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, দেশে স্কিন ব্যাংকের যাত্রা শুরুর পর দান করা ত্বক ব্যবহার করে ১০ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই বেঁচে গেছেন। আর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকায় একজন মারা গেছেন।
আপাতত রেজিস্ট্রেশন ও স্ক্রিনিং
দেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংক উদ্বোধন করা হয় গত ৯ জানুয়ারি। তবে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। ব্যাংকটিতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমানে এই ব্যাংকে দুজন চিকিৎসক ও একজন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন।
স্কিন ব্যাংক যাত্রা শুরুর পর মোট ১৪ হাজার ৫০০ সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মাইলস্টোনের ঘটনার আগপর্যন্ত ৯ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যাংকে ছিল। মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় গত রোববার পর্যন্ত এ ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যবহার করা হয়েছে।
স্কিন ব্যাংক যাত্রা শুরুর পর মোট ১৪ হাজার ৫০০ সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মাইলস্টোনের ঘটনার আগপর্যন্ত ৯ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ছিল। মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় গত রোববার পর্যন্ত এ ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যবহার করা হয়েছে।
মাইলস্টোনের ঘটনার পর ত্বকদানের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ত্বকদানের আহ্বান জানিয়ে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন। তবে কিছু কিছু ভুল তথ্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।
মাইলস্টোনের ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অনেকেই ত্বক দান করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্বক সংরক্ষিত আছে।
এ বিষয়ে চিকিৎসক মাহবুব হাসান বলেন, এ মুহূর্তে ত্বকদানে আগ্রহী ব্যক্তিদের রেজিস্ট্রেশন আর স্ক্রিনিং করে রাখার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তাঁদের কাছ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা যায়।
চিকিৎসক মাহবুব হাসান বলেন, ভবিষ্যতে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় ত্বক সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। ত্বক সংগ্রহের পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে সেই ত্বক পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
আলোচনা চলছে বহু আগে থেকে
২০১৯ সালে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু হয়। তবে এরও অনেক আগে থেকে স্কিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
১৯৯৯ সালে সরকার মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন করে। এই আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংজ্ঞায় কিডনি, যকৃৎসহ ত্বক বা চামড়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মৃত্যুর পরেও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার বিষয়টি আইনে উল্লেখ আছে। ২০১৮ সালে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা করা হয়।
শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেলে শরীর থেকে পানি, লবণ, প্রোটিন ও তাপ বেশি বের হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে। রোগীর ক্ষতস্থান দ্রুত চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে পারলে মৃত্যুঝুঁকি কমানো যায়। কিন্তু যখন শরীর বেশি পুড়ে যায়, তখন রোগীর নিজের শরীর থেকে ত্বক নেওয়া সম্ভব হয় না। তখন ত্বকদাতার দরকার হয়।
২০১৪ সালের ২৪ মার্চ ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘অ্যাসিড ও অন্যান্য পোড়া রোগীর চিকিত্সায় স্কিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথম আলো ও অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) যৌথভাবে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা বলেছিলেন, কেউ যদি স্বেচ্ছায় শরীরের ত্বক দান করেন, তাহলে যেকোনো দগ্ধ রোগীর জীবন বাঁচাবে। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, মৃত্যুর আগে ত্বকদানে ব্যক্তিগত সদিচ্ছা ও পরিবারের সহায়তা।
দাতাকে কাউন্সেলিং করা জরুরি
গত রোববার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কথা হয় স্কিন ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক আহমেদুল কবির চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেলে শরীর থেকে পানি, লবণ, প্রোটিন ও তাপ বেশি বের হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে। রোগীর ক্ষতস্থান দ্রুত চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে পারলে মৃত্যুঝুঁকি কমানো যায়। কিন্তু যখন শরীর বেশি পুড়ে যায়, তখন রোগীর নিজের শরীর থেকে ত্বক নেওয়া সম্ভব হয় না। তখন ত্বকদাতার দরকার হয়।
চিকিৎসক আহমেদুল কবির চৌধুরী ও মাহবুব হাসান জানান, মরণোত্তর ত্বকদাতার মৃত্যুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে ত্বক সংগ্রহ করতে হয়। জীবিত দাতাদের ক্ষেত্রে ত্বক দান করার পর ১৪ দিনের মধ্যে শরীরে নতুন ত্বক গজায়; যদিও শরীরে একটি দাগ রয়ে যায়। এসব বিষয়ে দাতাকে ভালোভাবে কাউন্সেলিং করা জরুরি। আবার কেউ যাতে টাকার বিনিময়ে ত্বক দান না করেন, সেটাও দেখতে হবে।
এই দুই চিকিৎসকের পরামর্শ হলো, দগ্ধ রোগীদের বাঁচাতে ত্বকদানের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ভ্রান্ত বিশ্বাস আর সামাজিক নানা ট্যাবু থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মরণোত্তর ত্বকদানের বিষয়টিকে বেশি উৎসাহিত করতে হবে।