
কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া থেকে ১ হাজার ২০০ পর্যটক নিয়ে জেলার প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে তিনটি পর্যটকবাহী জাহাজ। আজ সোমবার সকাল সাতটার দিকে নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে জাহাজ তিনটি রওনা দেয়।
সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া জাহাজ তিনটি হলো এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, এমভি বারআউলিয়া ও কেয়ারি সিন্দাবাদ। আজ বেলা দুইটা নাগাদ জাহাজ তিনটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাহাজগুলো আবার কক্সবাজারের উদ্দেশে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে আসবে।
আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা দুই মাস প্রতিদিন দুই হাজার করে পর্যটক সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ এবং রাত্রিযাপনের সুযোগ পাবেন। পর্যটকদের জন্য সাতটি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সকাল সাতটার দিকে বিআইডব্লিউটি জেটিঘাটে উপস্থিত হয়ে পর্যটকদের সরকারনির্ধারিত ১২টি বিধিনিষেধের কথা তুলে ধরেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, সরকারি বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। কোনোভাবেই পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা যাবে না। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকেরা বিধিনিষেধ মানছেন কি না, তা তদারক করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পৃথক দুটি দল কাজ করবে।
জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ঘাটে উপস্থিত ছিলেন টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান আপেল মাহমুদ, কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন, কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা প্রমুখ।
খন্দকার মাহবুব পাশা বলেন, পর্যটকেরা জাহাজে ওঠার আগে তাঁদের টিকিটটিতে নির্ধারিত কিউআর কোড রয়েছে কি না, তা যাচাই করা হয়েছে। কোনো পর্যটককেই প্লাস্টিক ও পলিথিন নিতে দেওয়া হয়নি। প্লাস্টিক বোতলের বিপরীতে পর্যটকদের প্রথম দিন পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে খাবার পানি রাখার অ্যালুমিনিয়াম বোতল বিতরণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দৈনিক দুই হাজারের বেশি পর্যটককে জাহাজে তুলতে দেওয়া হবে না। এ জন্য নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট ও সেন্ট মার্টিনের জেটিঘাটে পৃথক তল্লাশির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সকালে একটি জাহাজে নুনিয়ারছড়া থেকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের উদ্দেশে রওনা দেন ঢাকার রাজারবাগ এলাকার ব্যবসায়ী আজমল হুদা (৩৬)। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে দ্বীপটি ভ্রমণে গেছেন তিনি। জাহাজে ওঠার আগে তিনি বলেন, ‘এক রাত থেকে পরের দিন একই টিকিটে কক্সবাজারে ফিরে আসব। এর আগে কখনো সেন্ট মার্টিন যাইনি, কেবল মানুষের মুখে শুনেছি। আজ গিয়ে সত্যিকার অর্থেই দ্বীপটি দেখার সুযোগ হবে।’
রোকসানা ইসলাম (২৩) নামের এক তরুণী বলেন, জাহাজে চড়ে বিশাল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়া সত্যিই রোমাঞ্চকর। সাগর আর নীল জলের সেন্ট মার্টিন দেখার ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। দুটিই আজ পূরণ হচ্ছে।
মুফিজুর রহমান (৪২) নামে আরেক পর্যটক বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে টেকনাফ হয়ে জাহাজে সেন্ট মার্টিন গিয়েছিলাম। নাফ নদী ও মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের আনন্দ ভোলার মতো নয়। এবার অন্য পথে যাচ্ছি। আশা করি ভালোই লাগবে।’
জাহাজমালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, প্রথম দিনের যাত্রায় তিনটি জাহাজে ১ হাজার ২০০ জন পর্যটক সেন্ট মার্টিন গেছেন। তাঁরা সেখানকার হোটেলে রাত্রিযাপন করবেন। সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলার ক্ষেত্রে জাহাজেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ১ লাখ ১০ হাজারের মতো পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেছিলেন।

জাহাজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন সকাল সাতটার দিকে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ- জেটিঘাট থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ ছাড়বে। ১২০ কিলোমিটারের সাগরপথ পাড়ি দিয়ে জাহাজ বেলা দুইটার দিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পৌঁছাবে। বেলা তিনটার দিকে পর্যটক নিয়ে সেই জাহাজ আবার কক্সবাজারে ফিরে আসবে।
টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান আপেল মাহমুদ বলেন, জাহাজে এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে টুরিস্ট পুলিশ। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন টুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা।
সরকারি নির্দেশনা
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, গত ১ নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়; কিন্তু রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা না থাকা এবং জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় নভেম্বর মাসে একজন পর্যটক দ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারেননি। নভেম্বর মাসে দ্বীপে রাত্রিযাপনের কোনো সুযোগ ছিল না পর্যটকদের।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাস সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপনের সুযোগ রাখা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ টু৵রিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড যুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।
সেন্ট মার্টিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে রাতের বেলায় সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিষিদ্ধ করা হয়। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ, নিষিদ্ধ পলিথিন বহন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, পানির প্লাস্টিক বোতল) ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
















