‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে কী বোঝাতে চাইছে জাতীয় নাগরিক পার্টি

0
10

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। গতকাল শুক্রবার নতুন এ দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এমনটাই জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কী বোঝাতে চাইছেন, সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।

‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি ফ্রান্সের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে এটি। এটি এমন একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন।

উদাহরণ হিসেবে ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। এটি একসময় রাজতন্ত্রের অধীন ছিল। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লব চলে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তবে বিপ্লব চলার মধ্যেই ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়।

ফ্রান্সে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত প্রথম রিপাবলিক টিকে ছিল। এরপর আবার রাজতন্ত্র শুরু হয়। এ পর্ব চলে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এটি টিকে ছিল ১৮৫২ সাল পর্যন্ত। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ফ্রান্সের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দফায় দফায় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে এখন চলছে পঞ্চম রিপাবলিক।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দলে দলে হাজির হন সমর্থকেরা
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দলে দলে হাজির হন সমর্থকেরা

বাংলাদেশেও আলোচনায় ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’

‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে জাতীয় নাগরিক পার্টি আসলে কী বোঝাতে চাইছে, এ বিষয়ে কথা হয় দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের সঙ্গে। তিনি জানান, এ ভূখণ্ডের মানুষের সব লড়াই একীভূত করে মানুষের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন—‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে এটিই বোঝাচ্ছেন তাঁরা।

আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কিছু কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। এই কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে।’

সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন।

গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদ রীতিমতো গেড়ে বসেছিল উল্লেখ করে এই তরুণ নেতা বলেন, ‘এই ফ্যাসিবাদকে সরাতে দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। সেই জায়গা থেকে সংবিধানের কাঠামোটা এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে কোনো দল ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে।’

আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র‌্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই আমরা “সেকেন্ড রিপাবলিক” বলছি।’

আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ছয় মাস ধরে এ বিষয়কেই আমরা সেকেন্ড রিপাবলিক বা জুলাই ঘোষণাপত্র বলে আসছিলাম। প্রথম রিপাবলিকের পর দ্বিতীয় রিপাবলিক—এটা অন্য অনেক দেশেও হয়েছে, যেমন ফ্রান্স, কোরিয়ায় দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত রিপাবলিক হয়েছে। এতে কোনো অসুবিধা নেই’।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র‌্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই আমরা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলছি।

আরিফুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক

সেকেন্ড রিপাবলিক প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব আছে কি না, তা জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘আমরা সংবিধান বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক করা হলে এর ওপর ভিত্তি করে সংবিধানের বড় পরিবর্তন করা সম্ভব।’

আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এখন তো সংবিধানের মূল ভিত্তি রেখে সংশোধন হয়। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক হলে রিপাবলিকটাই হবে মূল ভিত্তি। সেটার ওপর ভিত্তি করে সংবিধান পুনর্লিখনও হতে পারে অথবা কাটাছেঁড়াও হতে পারে। জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য তো আমরা সরকারের কাছে একটা প্রস্তাবনা দিয়েছি। যদিও সরকার এখনো জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারেনি। এটা নিয়ে এখনো কাজ চলছে।’

যেভাবে আলোচনায় আসে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণা প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র–জনতার গণজমায়েত’ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। সেটিরই একটি ছিল ‘জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা এবং এর ভিত্তিতে দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা’।

এরপর ওই পাঁচ দফা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরা। শেষ পর্যন্ত দলগুলোর কাছ থেকে এসব দাবির ব্যাপারে সরাসরি ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ ধারণাটি পরে আর সেভাবে সামনে আসেনি। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবিও কয়েক মাস ধরেই করে আসছেন তাঁরা।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটিও তাদের সঙ্গে ছিল। ঘোষণাপত্র প্রকাশ সামনে রেখে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাংলামোটরে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ মাধ্যমে বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের ‘কবর’ রচিত হবে।

ঘোষণাপত্রে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণার কোনো বিষয় আছে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সেদিন হাসনাত আবদুল্লাহর উত্তর ছিল, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) আইনগত বিষয়। সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে আমরা এখন যাচ্ছি না।’

ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশে সরকারকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সেই লক্ষ্যে জনমত তৈরিতে ৬ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রচারপত্র বিলি ও জনসংযোগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।

তবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকার কোনো ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেনি। ১৬ জানুয়ারি ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সংলাপের পরবর্তী কর্মপন্থা হিসেবে মতামত নিতে ওই দিনই রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের চিঠি দেওয়া হয়। অভিমত পর্যালোচনা করে একটি সংশোধিত ও সর্বজনগ্রাহ্য ঘোষণাপত্র প্রস্তুত এবং জনগণের উপস্থিতিতে অনতিবিলম্বে তা ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়।

এখন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেই বললেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’

‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ বদরুল হাসান বলেন, ফ্রান্সসহ যেসব সমাজে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পরিবর্তনগুলো হয়েছে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশেও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি যে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে, তাদের নিশ্চয়ই একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা আছে। সময়ই বলে দেবে এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যটা আসলে কী বা সেটা দেশের জন্য কী বয়ে আনবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.