সুন্দরবন উপকূলে চিংড়িতে জেলি পুশ বাড়ছেই, তিনভাবে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা

0
149
খুলনার কয়রা উপজেলায় ওজন বাড়ানোর জন্য জেলি পুশ করায় ২৫০ কেজি চিংড়ি মাটিতে পুঁতে বিনষ্ট করা হয়। গত বুধবার দুপুরে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশে

ভোরের আলো ফোটার আগেই ভ্যান-ইজিবাইক-মোটরসাইকেল-নসিমন ভরে দূরদূরান্ত থেকে আসতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মাছ। বেলা ১১টা পর্যন্ত হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে মুখর থাকে খুলনার সুন্দরবন উপকূলের কয়রা উপজেলার দেউলিয়া বাজার মৎস্য আড়ত। সেখান থেকে মাছ কেনেন ব্যবসায়ীরা। এরপর কয়রার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা প্রায় পাঁচ শ ডিপোতে (ঘর) রেখে এসব চিংড়ি মাছে সিরিঞ্জ দিয়ে জেলিসহ বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢোকান অসাধু ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয় প্রশাসন ও চিংড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। এসব মাছে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। ভেজাল চিংড়ি রপ্তানি হলে দেশের খ্যাতি নষ্ট হওয়ার সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও জেলি ঢোকানোর (পুশ করার) এই প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না।

মৎস্য অফিস ও ব্যবসায়ীরা জানান, সুন্দরবন উপকূলীয় কয়রার চিংড়ির সারা দেশে বেশ কদর রয়েছে। এই কারণে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ভাতের মাড় বা সাবুদানা এবং আরও কয়েক প্রকার রাসায়নিকের ব্যবহারে তৈরি জেলি চিংড়ির শরীরে সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করে ওজন বাড়ান। এতে মাছের ওজন বেড়ে প্রতি কেজিতে ১৫০ টাকা বেশি পান তাঁরা।

কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রায় অভিযান চালিয়ে গত তিন মাসে জেলি পুশ করা ৮২৩ কেজি চিংড়ি জব্দ করে বিনষ্ট করা হয়েছে। তিন মাসের মোট ১১টি অভিযানে ১০ জন অসাধু মাছ ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় কয়েকজনকে।

সর্বশেষ ৫ জুলাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে দেউলিয়া বাজার মৎস্য আড়ত থেকে জেলি পুশ করা ২৫০ কেজি চিংড়ি জব্দ করা হয়। এই অভিযানের এক দিন আগে, ৩ জুলাই একই স্থান থেকে ২১০ কেজি জেলি পুশ করা চিংড়ি জব্দ করা হয়েছিল। জব্দ করা চিংড়ি জনসম্মুখে মাটিতে পুঁতে বিনষ্ট করেন কয়রা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক।

দেখা গেছে, চিংড়িতে পুশের কারণে মধ্যস্বত্বভোগী মাছ ব্যবসায়ী ফড়িয়া ও কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী লাভবান হলেও লোকসানে স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা। গত বছর বড় আকারের চিংড়ির প্রতি কেজির দাম ছিল এক হাজার টাকা। বর্তমানে সেগুলোর দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। মাঝারি আকারের যেসব চিংড়ি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, বর্তমানে সেগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ছোট আকারের চিংড়ি গত বছর ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

চাষিরা জানান, মাঝারি আকারের প্রতি কেজি চিংড়ি উৎপাদনে ব্যয় হয় ৫০০ টাকারও বেশি। রয়েছে মৎস্য ঘেরে মাছের খাবার খরচ, শ্রমিকের মজুরি, জমির মালিকের লিজ চুক্তির টাকা ও আনুষঙ্গিক খরচ।

কয়রার গোবরা গ্রামের আলমগীর হোসেন নামের এক চিংড়ি চাষি বলেন, ‘গত বছর অতিবৃষ্টিতে মাছ ভেসে গেছে। বছরে কয়েকবার রোগের কারণে চিংড়ি মারা যায়। এরপর আবার জেলি পুশের কারণে দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষ করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার খেসারত দিতে হয় আমাদের মতো সাধারণ চিংড়িচাষিদের।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিংড়ি মাছে জেলি পুশের সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী বলেন, কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম জেলি পুশ করা যায়। এতে মাছের আকার হিসেবে দাম বেড়ে যায়।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কয়রার দেউলিয়া বাজার, ফুলতলা বাজার, পায়রাতলা, হায়াতখালী, বানিয়াখালী, দেয়াড়া, হোগলা বাজার, চৌকুনী বাজার, বায়লাহারানিয়াসহ সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার মৎস্য ডিপোগুলোতে চিংড়িতে জেলি পুশের প্রবণতা বেশি। এসব এলাকা থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে মাছ ঢাকার সাভার, সদরঘাট, কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের আড়ত ও মাছ কোম্পানিতে চালান করা হয়।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘প্রতিবছর আমাদের দক্ষিণাঞ্চল থেকে গড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি হয়। তবে জেলি পুশ করার কারণে রপ্তানির পর একাধিকবার বিদেশ থেকে এসব চিংড়ি ফেরত এসেছে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে বিদেশের বাজারে আমাদের দেশের সুনাম নষ্ট হবে।’

কয়রা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক বলেন, জেলিযুক্ত চিংড়ি মাছে ক্রেতারা তিনভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রথমত ওজন প্রতারণা, দ্বিতীয়ত দাম বেশি ও সর্বশেষ মাছের গুণগত মান নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে। এই কারণে তাঁরা চেষ্টা করছেন ঘন ঘন অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের বাধার মধ্যে ফেলতে। তিনি বলেন, ‘আমরা অভিযান করছি, শাস্তির আওতায় নিয়ে আসছি। অথচ, পরবর্তী সময় দেখা যাচ্ছে, তারা আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.