নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে কষ্টে আছে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে টাকার সরবরাহ আরও কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিতে হবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। পাশাপাশি লাগাম টানা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণেও। এ দুই পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পাশাপাশি ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে; যাতে ডলারের দাম অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখে ওঠানামা করবে। জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এসব ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে নতুন পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগে ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি’ গঠনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। আর ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের চলমান সংকটকে ‘কাঠামোগত দুর্বলতা’ হিসেবে অভিহিত করেছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সরকারের লক্ষ্য আগামী জুনে সাড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত মুদ্রানীতির সংকোচনমূলক ধারা অব্যাহত থাকবে।
ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ শতাংশ উঠেছে, এরপরও মূল্যস্ফীতি না কমার কারণ সম্পর্কে গভর্নর বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে নেওয়া উদ্যোগের প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে সময় লাগে। এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে না, শেষ দুই মাসে কিছুটা কমেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলেও কোনো সমস্যা নেই। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে অর্থনীতির পাশাপাশি অর্থনীতি-বহির্ভূত কারণও রয়েছে। এ নিয়ে নতুন অর্থমন্ত্রী আগামী রোববার সভা ডেকেছেন।’
ডলার-সংকট প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। এখন বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণের প্রকল্পের অর্থছাড় ও বাণিজ্য অর্থায়নের ঋণ বাড়বে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও কমে আসবে। তাতে সামনে ডলারের ওপর চাপ কমে যাবে। তবে ডলার-সংকট কবে নাগাদ কাটবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি গভর্নর।
মুদ্রানীতিতে যেসব পদক্ষেপ
আগামী ছয় মাসের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ৭.৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বাড়তি সুদ গুনতে হবে ব্যাংকগুলোকে। বর্তমানে তারল্য সংকটে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংক বিল-বন্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ধার করছে। নিয়ম অনুযায়ী, নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের জন্য এই ধার করছে বেশির ভাগ ব্যাংক।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়বে। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া আগামী জুন শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, আগে যা ছিল ১১ শতাংশ। পাশাপাশি সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমিয়ে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে, আগে যা ছিল ৩১ শতাংশ।
এর বাইরে বিশেষ উপায়ে টাকা ধার বা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে, আগে যা ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ সুদ কমানোর মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে টাকা ধার নেওয়া ব্যাংকগুলোকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো সুদহার বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশীয় পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশীয় পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে।
চালু হচ্ছে ‘ক্রলিং পেগ’
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে। আগে শুধু জোগান-চাহিদার ওপর ডলারের দাম ওঠানামা করত। নতুন পদ্ধতির ফলে অর্থনীতির মৌলিক অবস্থা বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে-কমবে। তবে কবে থেকে এই পদ্ধতি চালু হবে ও এর ফলে ডলারের দাম কত হবে, তা জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি দল ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির বিষয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে আসবে। এরপরই তাদের কারিগরি সহায়তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পদ্ধতি চালু করতে চায়।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, নতুন পদ্ধতি চালু হলে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হবে।
বর্তমানে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা। তবে আমদানিতে ডলারের দাম ১২০ টাকার বেশি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ডলার-সংকটে চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফাও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
খেলাপি ঋণ, সুশাসন ও তারল্যসংকট
ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগে ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি’ গঠনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণায় বলা হয়, ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা, এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাছে ছিল ১৫ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে অতিরিক্ত তারল্য কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া নীতির ফলে তারল্য পরিস্থিতি এই আকার হয়েছে।
এ বিষয়ে পরে গভর্নর বলেন, গত আড়াই বছরে রিজার্ভ থেকে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এসব অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে এসেছে। এতে তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে।
যে চ্যালেঞ্জ দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দামে অস্থিতিশীলতা, বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দামের ওঠানামা, মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় না আসা, মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা ও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে না কমে আসা পর্যন্ত নীতি উদ্যোগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, আবু ফরাহ মো. নাছের, নুরুন নাহারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন