সিলেট সিটি নির্বাচনে ‘ঘরের মানুষই’ আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে এখন একটাই প্রশ্ন—গত নির্বাচনের মতো এবারও কি দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীকে নিজ দলের নেতাদের ‘অপ্রকাশ্য’ বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বিগত দুটি নির্বাচনে সিলেটে দলের প্রার্থী জয় পাননি। তাই এবার নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে চান। অতীতের তুলনায় বর্তমানে সিলেটে দল সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ বলে তিনি দাবি করেন।
অবশ্য মনোনয়নবঞ্চিত ও মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে মনের কথা পেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মহানগরের রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন একজন প্রবাসী নেতা মনোনয়ন পাওয়ায় ভেতরে-ভেতরে অনেকে ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তাঁদের ক্ষোভের ‘বহিঃপ্রকাশ’ ভোটে পড়তে পারে।
১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সিলেটে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। তিনিসহ দলের ১১ জন নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। গুঞ্জন আছে, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর ফয়জুল আনোয়ার আলাওর ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হতে পারেন। যদিও ১১ মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে তিনি ছিলেন না।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। নির্বাচনের পরপরই এমন অভিযোগে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এবার প্রকাশ্য বিরোধিতা না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গত দুটি সংসদীয় নির্বাচনে সিলেট-২ (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) আসনে দলের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। গত ২২ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে মেয়র পদে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের কথা জানান। স্থানীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ডিঙিয়ে আনোয়ারুজ্জামান মনোনয়ন পাওয়ায় এখন দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। প্রথমত কেউ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হবেন কি না এবং দ্বিতীয়ত মনোনয়নবঞ্চিতরা তাঁর পক্ষে কাজ করবেন কি না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ১৭ এপ্রিল বিমানে সিলেটে আসার পর বিমানবন্দরে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। তখন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত থাকলেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ১১ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন আরমান আহমদ ও ছালেহ আহমদ। পরে ২১ এপ্রিল নগরের ধোপাদীঘিরপাড় এলাকায় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে একটি মতবিনিময় সভায় পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশী অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল, আজাদুর রহমান এবং সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী। গতকাল বুধবার পর্যন্ত তাঁদের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।
সূত্র জানায়, ওই পাঁচ নেতার মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক আজাদুর রহমান মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই দেশের বাইরে যান। মঙ্গলবার আজাদুর দেশে ফেরেন। অন্যদিকে মিসবাহ উদ্দিন, এ টি এম এ হাসান ও প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী সিলেটে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে আজাদুর, এ টি এম এ হাসান ও সদরুজ্জামান বলেন, আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে তাঁরা মাঠে নামবেন। মিসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘সিলেটে পৌঁছে তিনি (আনোয়ারুজ্জামান) আমার বাসায়ও এসেছিলেন। একাধিকবার তাঁর সঙ্গে কথাও হয়েছে। দল যেহেতু তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে, প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে অবশ্যই তাঁর পক্ষে মাঠে নামব।’
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘অনেকেই গুজব ছড়াচ্ছেন। আসলে দলের কেউই বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন না। যাঁরা হবেন বলে গুঞ্জন ছড়ানো হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। কারও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। সবাই নৌকার সমর্থনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।’
মহানগর আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরের তালতলা এলাকার একটি হোটেলে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিতে সাংগঠনিক প্রস্তুতি চূড়ান্তকরণ, ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হতে পারে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, দল যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেটাই সবাইকে মানতে হবে। কোন্দল এড়াতে জরুরি সভা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা এমন নয়। প্রার্থী রাইট না কি রং—এটা এখন আর আলোচ্য বিষয় না। নেত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাই নৌকার বিজয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এখানে কোন্দল বা বিভেদের কিছু নেই। প্রার্থীর জয় নিশ্চিতে করণীয় বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।’
মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতাকে এখনো দলীয় প্রার্থীর পাশে দেখা যায়নি, এ ব্যাপারে মাসুক উদ্দিন বলেন, প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে সবাই নিশ্চয়ই মাঠে নামবেন। তবে দু-একজন যাঁরা রুষ্ট, তাঁরা পার্টি করেন ঠিকই, সেটা তাঁদের মতো করে করেন। মনেপ্রাণে তাঁরা আওয়ামী লীগ করেন না। মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ করলে তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২১ জুন ইভিএমে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে। ২৩ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৫ মে আর প্রত্যাহারের শেষ দিন ১ জুন।