সিপিবির ত্রয়োদশ সম্মেলন যারা নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক করছে, তারা গণতন্ত্রের শত্রু

0
7
জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধন করা হয়। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে

নির্বাচিত সরকার ছাড়া আজকে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না। তাই যারা সামনের নির্বাচন নিয়ে নানা কৌশলে বিতর্ক তুলছে এবং জাতীয় সংগীত পাল্টে দিতে হবে, ৭২ এর সংবিধান বাতিল করতে হবে, চার মূলনীতি বাতিল করতে হবে বলে দাবি করছে, তারাই এখন গণতন্ত্রের শত্রু। কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম।

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় সিপিবির চার দিনব্যাপী ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন শাহ আলম। এর আগে বিকেল ৩টায় জাতীয় সংগীত ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন সিপিবি সভাপতি।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা উপভোগ করছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘নির্বাচন যদি না হয়, এই খেলা (নির্বাচন না দেওয়া) চলতে থাকবে। আর নির্বাচন হলে একটা সেন্টারে ক্ষমতা আসবে। তাই আমাদের বর্তমানের স্লোগান হল, “অতি সত্ত্বর দরকার, নির্বাচিত সরকার”। নির্বাচিত সরকার ছাড়া আজকে বাংলাদেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না, নির্বাচিত সরকার ছাড়া আজকে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হবে না।’

গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রের শত্রু ছিল উল্লেখ করে সিপিবি সভাপতি বলেন, বর্তমানে গণতন্ত্রের শত্রু হলো সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি নানা উসিলায় এই নির্বাচনের বিরোধিতা করছে উল্লেখ করে তিনি সতর্ক করেন যে, নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং মৌলবাদী শক্তির আরও বেশি উত্থান হবে।

মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার, শ্রেণি চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হয় নাই, বিপ্লব হয় নাই। একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে।’

দেশের বামপন্থী, কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলদের দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটছে উল্লেখ করে সিপিবির সভাপতি বলেন, ‘বামদের সুবিধাবাদ, বিভেদ এবং হটকারিতা আর রাজনীতির দেউলিয়াত্বের কারণেই আজকে রেডিক্যাল ইসলামের উত্থান হয়েছে বাংলাদেশে।’ সেজন্য কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ বিকল্প গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দলের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দলের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে সিপিবি ‘বিন্দুমাত্র ভুল’ করেনি উল্লেখ কর মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘লালবদর বলে আমাদেরকে এই আন্দোলনে থাকার কারণে। এখন বুঝেন, কী হয়েছে। এ রকম নানা বিতর্ক আজকে বিভিন্নভাবে আসছে। আমরা মনে করি, এগুলো ভুল। আমরা সঠিকভাবেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি।’

জুলাই সনদকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না, এ দাবির সমালোচনা করেন সিপিবির সভাপতি। একে চক্রান্ত আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজাতে হবে বলে নেতা–কর্মীদের সতর্ক করেন তিনি। মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা, একবার হারিয়েছি, আরেক সম্ভাবনা আমার দোরগোড়ায় নাড়া দিচ্ছে। ওই সম্ভাবনা আমাদেরকে ধরতে হবে।’

মোহাম্মদ শাহ আলমের বক্তব্যে উঠে আসে বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষিতও। তিনি বলেন, পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে। আমেরিকা আজকে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াকে ফেলে শেষ করে দিয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের টাইকুনরা আজকে নয়া উপনিবেশ সৃষ্টি করছে বিভিন্ন দেশকে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মানবিক করিডর সংক্রান্ত ইস্যু তুলে সিপিবির সভাপতি বলেন, ‘এখানে করিডোর দিয়ে বার্মার সাথে আমাদের যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে চায়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটাকেও ফেইলড স্টেটের (ব্যর্থ রাষ্ট্র) দিকে নিয়ে যেতে চায়। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ, আমেরিকান সাম্রাজ্য, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সৈন্যরা আজকে এখানে যৌথ মহড়া দিচ্ছে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে

‘বিরাজনীতিকীকরণের অপতৎপরতা চলছে’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতজানু নীতির কারণে গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়কে নস্যাৎ করতে পরাজিত ফ্যাসিস্টবাহিনী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী বিদেশি শক্তিসহ দেশের ভেতরের নানা শক্তি অপতৎপরতা চালাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাবিরোধী নানা তৎপরতা চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা, সাম্প্রদায়িক নানা অপশক্তির হামলা ও আস্ফালন, দখলদারিত্ব, নৈরাজ্য, মামলা বাণিজ্য, মব সন্ত্রাস ও নারীবিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বিরাজনীতিকীকরণের শক্তিকে সামনে আনতে নানা অপতৎপরতা চলছে।

এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বামপন্থী দল, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিকল্প শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান রুহিন হোসেন।

সিপিবির চারদিনব্যাপী কংগ্রেস শুরু

‘সমাজ বদলের লক্ষ্যে শোষণ-বৈষম্যহীন বাম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করো’—এই স্লোগান নিয়ে সিপিবির চার দিনব্যাপী ত্রয়োদশ কংগ্রেস শুরু হয়েছে। আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয় সংগীত ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এবারের কংগ্রেসের উদ্বোধন করা হয়। সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান আবু সাইদ। এ সময় সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এরপর উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুরু হয় কাউন্সিল অধিবেশন। কংগ্রেস চলবে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এবারের কংগ্রেসে অংশ নিচ্ছেন জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৫২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৬ জন পর্যবেক্ষক। সম্মেলনে পার্টির প্রবীণ নেতাদের মধ্যে যাদের বয়স ৭০ বছর পার হয়েছে বা একটানা ৩০ বছর সিপিবির কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন, তাঁদের সম্মাননা দেওয়া হয়। এ সময় তাঁদের হাতে ফুল, শুভেচ্ছা বার্তা এবং সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত দলের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকেরা। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত দলের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকেরা। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে

পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এবারের কংগ্রেসে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে রণকৌশল রচনা, আগামী দিনের সংগ্রামমূলক কর্মকাণ্ড নির্ধারণ এবং কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে। এরই অংশ হিসেবে তিন মাস আগে সব শাখা, থানা, উপজেলা ও জেলায় নীতি-প্রস্তাব ও কর্মসূচির খসড়া পাঠানো হয়। সেসব আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতেই কংগ্রেসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কংগ্রেসে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের কণ্ঠে ছিল ঐক্যের সুর। সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বের মাঝে তারা ‘লড়াই, লড়াই চাই/লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘ঐক্য, ঐক্য, ঐক্য চাই/বামপন্থীদের ঐক্য চাই’, ‘সামনে আছে জোর লড়াই/কমিউনিস্টদের ঐক্য চাই’, ‘বিভেদ না, ঐক্য-ঐক্য, ঐক্য’, ‘দুনিয়ার মজদুর/এক হও’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ

সিপিবির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দলের নেতারা। এর মধ্যে গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বাসদের (মার্কসবাদী) প্রধান সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সম্পাদক আব্দুল আলী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (ভাসানী) আহ্বায়ক মহিউদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, সাংগঠনিক সম্পাদক করিম শিকদার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশারেফা মিশু, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন প্রমুখ।

বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছা

সিপিবির এবারের কংগ্রেসের সফলতা কামনা করে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট ও বাম রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী), জাপানের কমিউনিস্ট পার্টি, অস্ট্রেলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি, কুর্দিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি, নেদারল্যান্ডসের নিউ কমিউনিস্ট পার্টি, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রীলঙ্কার কমিউনিস্ট পার্টি, ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি, গ্রীসের কমিউনিস্ট পার্টি, ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.