গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন থেকে আউটার সিগন্যালটির দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। বাড়িঘর কম থাকায় চারপাশে বিরাজ করে নির্জনতা। রাত ১০টা পার হলে এখানে ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারীদের দল। সিগন্যালে ট্রেন থামলে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তারা। মুহূর্তেই ট্রেনের জানালা দিয়ে যাত্রীদের মুঠোফোন, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়। বাধা পেলেই চালায় ছুরি, ছুড়তে থাকে পাথর।
টঙ্গী রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনে ছিনতাই ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছে টঙ্গী পূর্ব থানা ও রেলওয়ে পুলিশ। ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলপথ ভ্রমণকারীদের জন্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। রেললাইনের পাশে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা অনেক সময় চলতি ট্রেনেও থাবা দিয়ে মুঠোফোন, স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালে চট্টগ্রাম থেকে আসা ঢাকাগামী ‘কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ছিনতাই ও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষকসহ (টিটিই) কয়েকজন যাত্রী আহত হন। হামলা ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওই রাতেই রেলস্টেশনের আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে রেলওয়ে ও টঙ্গী পূর্ব থানা-পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি চাইনিজ কুড়াল, দুটি চাকু ও ছিনতাই হওয়া কয়েকটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মেহেদী হাসান ওরফে জয় (২৬), মো. রনি (৩৫), রবিউল হাসান (৪০), মো. স্বাধীন (৩০), সাইফুল ইসলাম (২৫), মো. মাসুদ (২৭), মো. নাসির (২০), মো. নয়ন হাসান (২৮) ও মো. আশিক (২২)। তাঁদের সবার বসবাস টঙ্গী রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকায়। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
রেলওয়ের কর্মকর্তা, পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্টেশনে ট্রেন থাকা অবস্থায় নতুন ট্রেন এলে সেটিকে প্রথমে আউটার সিগন্যালে থামানো হয়। এরপর লাইন ফাঁকা হলে ওই ট্রেনকে স্টেশনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। আউটার সিগন্যালে ট্রেন থামলেই ছিনতাইকারীরা জানালা দিয়ে যাত্রীদের মুঠোফোন, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়। কেউ বাধা দিলে তাকে চাকু দিয়ে আঘাত, মারধরসহ পাথর মেরে জখম করে ছিনতাইকারীরা। এসব কারণে আউটার সিগন্যালটিতে ট্রেন থামলে যাত্রীরা একধরনের আতঙ্কে থাকেন।
বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টঙ্গী পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াসিন আরাফাত বলেন, কর্ণফুলী কমিউটার ট্রেনটি বৃহস্পতিবার রাতে আউটার সিগন্যালে থামার পর এক যাত্রী কোনো কারণে ট্রেন থেকে নিচে নামেন। আর তখনই মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে কয়েকজন ওই যাত্রীকে চাকু ধরে মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তাঁরা ট্রেনের বগিতে ওঠার চেষ্টা করে। এ সময় যাত্রীরা বাধা দিলে খারাপ ব্যবহারসহ মারধর করে। এর মধ্যেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ছিনতাইকারী দলের অন্যরা। একপর্যায়ে আতঙ্ক তৈরির জন্য ছুড়তে থাকে মুহুর্মুহু পাথর। পরে যাত্রীদের কেউ একজন পুলিশে খবর দিলে ট্রেনটি দ্রুত স্টেশনে আনার ব্যবস্থা করা হয়।
এসআই ইয়াসিন আরাফাত বলেন, গ্রেপ্তার নয়জন আসামির সবাই চিহ্নিত ছিনতাইকারী। তিনি নিজে আগে–পরে এঁদের বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছেন। জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়েন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টি স্থান এমন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে উত্তরার জয়নাল মার্কেট, আবদুল্লাহপুর, বউবাজার, মিরাশপাড়া, নতুন বাজার, মাজারটেক বস্তি, কেরানিটেক বস্তি, আকিজ বেকার্সের পেছনে, বনমালা, হায়দ্রাবাদ, সুকন্দিরবাগ, ধীরাশ্রমসহ কিছু জায়গা উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় রেললাইনের পাশেই ওত পেতে থাকে দুর্বৃত্তরা। কোনো কারণে ট্রেনের গতি কমলে বা সিগন্যাল পড়লে ট্রেনের জানালার পাশে থাকা ব্যক্তিদের মুঠোফোন, গয়না বা অন্য জিনিসপত্র নিতে টান দেয়। এতে অনেক সময় ঘটে দুর্ঘটনা।
জয়দেবপুর থেকে ঢাকার বিমানবন্দর পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াতে করেন ইকরামুল হাসান রাব্বি। তিনি বলেন, টঙ্গীর রেলস্টেনের আশপাশ, বিশেষ করে জিআরপি কলোনি এলাকাটা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে রেললাইনের পাশে প্রচুর ঝোপঝাড়। কেউ দিনের বেলা এসব ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে বোঝার উপায় নেই। এর মধ্যে রাতে তৈরি হয় আরও বেশি খারাপ অবস্থা। এখানে কোনো কারণে ট্রেন থামলে সবাই সতর্ক থাকে। যারা জানে, তারা আগে থাকেই জানালা বন্ধ করে দেয়।
এই রেলপথে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে প্রাণহানির নজিরও রয়েছে। ২০২০ সালের ৬ মার্চ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম (২৫)। রাত ১০টার দিকে ট্রেনটি থামে টঙ্গী রেলজংশনে। রাকিবুল তখন ট্রেনে জানালার পাশে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ করেই হ্যাঁচকা টানে রাকিবুলের মুঠোফোনটি নিয়ে দৌড় দেয় এক ছিনতাইকারী। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থেকে নেমে রাকিবুলও ছোটেন পিছু পিছু। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, রেললাইন ধরে কিছুদূর যেতেই ওই ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন রাকিবুল। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তাঁর বুকে চাকু মেরে বসেন ওই ছিনতাইকারী। গুরুতর আহত রাকিবুলকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
এ বছরের জানুয়ারিতে টঙ্গী রেলস্টেশনে বিশ্ব ইজতেমার বিশেষ ট্রেনে ছিনতাইয়ে বাধা দিতে গিয়ে ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে পুলিশের তিন সদস্য আহত হন। এ সময় দুটি ধারালো ছুরিসহ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসব ঘটনা আগে আরও অনেক বেশি থাকলেও এখন অনেকাংশেই কমে গেছে বলে দাবি কমলাপুর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক ফেরদৌস আহম্মেদ বিশ্বাসের। তিনি বলেন, এখন এসব বিষয়ে খুব একটা অভিযোগ পাওয়া যায় না। হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তাঁদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।
ফেরদৌস আহমেদ বলেন, বৃহস্পতিবারের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এ জন্য রিমান্ড আবেদন জানিয়ে আসামিদের আদালতে হাজির করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ ঘটনার সঙ্গে আর কে কে জড়িত বা তারা কত দিন এভাবে ছিনতাই করছে, তার বিস্তারিত জানা যাবে।