ফরিদপুরের আলোচিত সহোদর সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে করা ২ হাজার কোটি টাকা পাচার মামলার তদন্ত নাটকীয় মোড় নিয়েছে। এ মামলার দ্বিতীয় দফা অভিযোগপত্রে নতুন করে উঠছে প্রভাবশালী আরও অন্তত ১৫ জনের নাম। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফরিদপুর সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরী, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম, সাবেক পৌর মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথুও। অনেক প্রভাবশালী নেতা ও ব্যবসায়ীর নাম বাদ দিয়ে গত মার্চে এই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ওই মামলায় সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহ্তেশাম হোসেন বাবর, মন্ত্রীর তৎকালীন এপিএস এএইচএম ফোয়াদসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছিল। সিআইডির তদন্তের বেশ কিছু ত্রুটি আদালতের নজরে আসে। তাই ‘ভুলে ভরা’ অভিযোগপত্র আমলে না নিয়ে মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দ্বিতীয় দফায় কয়েক মাস তদন্তের পর আগের ১০ আসামিসহ নতুন করে শিগগিরই অভিযোগপত্র জমা দিতে যাচ্ছে সিআইডি। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, আদালতের নির্দেশে বরকত-রুবেলের মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু করা হয়। আমরা তদন্ত কাজের শেষ পর্যায়ে রয়েছি। অল্প সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
তবে এত সংখ্যক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি করে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ায় সিআইডির প্রথম দফায় তদন্তসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত মার্চে আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র যখন দাখিল করা হয় তখন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ছিলেন অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। সিআইডির নীতিনির্ধারকদের ‘ম্যানেজ’ না করে এত গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অসম্পূর্ণ অভিযোগপত্র দাখিল করা অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ের তদন্তসংশ্নিষ্টদের চাপে রেখে অনেকের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ মাঝপথে তদন্ত থেকে সরেও যেতে চেয়েছিলেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও অফিসপ্রধানকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁর অনুমোদন ছাড়া এ আইনের মামলার অভিযোগপত্র আদালত নেন না। এ ছাড়া আদালতও পর্যবেক্ষণে অভিযোগপত্রে বেশ কিছু দুর্বলতার কথা বলেছেন।
নতুন অভিযোগপত্রে যা যুক্ত হচ্ছে :প্রথম দফায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আদালত ছয়টি কারণ দেখিয়ে ফের এ মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে একটি ছিল বরকত-রুবেলের জমির সব দলিল জব্দ করেনি সিআইডি। অবৈধভাবে টাকা আয় করে মোট ৪৮৭টি দলিলে ৫ হাজার ৩৮৮ বিঘা জমির মালিক হন দুই ভাই। তবে তাঁদের ১১৩টি দলিল জব্দ করা হয়। বাকি ৩৭৪টি দলিল জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বরকত-রুবেলের নামে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাও জব্দ করা হয়নি। দ্বিতীয় দফার তদন্তে আদালতের নির্দেশনা মেনে দুই ভাইয়ের জমির সব দলিল জব্দ করা হয়েছে। পুনঃতদন্তে এরই মধ্যে অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা দুই ভাইয়ের নামে থাকা আটটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলেছে। সিআইডির একটি বিশেষ তদন্ত দল এরই মধ্যে কয়েক দফা ঢাকা থেকে সরেজমিন ফরিদপুর গেছে। জমি জব্দ করতে তাঁরা জেলার রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জব্দ করা হয়েছে দুই ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুর জেলা রেজিস্ট্রার আকবর আলী বলেন, বরকত-রুবেলের জমির দলিল জব্দ করতে আদালত সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশনার আলোকে সিআইডিকে কয়েক মাস ধরে খুঁজে খুঁজে দুই ভাইয়ের তিনশর বেশি দলিলের নথিপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর পর তা জব্দ করেছে সিআইডি।
আসামির তালিকায় নতুন যাঁরা :দ্বিতীয় দফা তদন্তে নতুন করে আরও অন্তত ১৫ জন আসামি হচ্ছেন। রহস্যজনক কারণে অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। সিআইডির প্রথম দফার তদন্তে এমন একাধিক ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা নিজের অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। এমনকি অন্যদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতেও অপরাধী হিসেবে তাঁদের নাম উঠে আসে। আদালত মামলার জব্দ তালিকা, অভিযোগপত্র, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও কেস ডকেট পর্যালোচনা করে দেখেন, নিশান মাহমুদ শামীম ও বিল্লাল হোসেন নামে দু’জনের নাম অভিযোগপত্রে রাখা হয়নি। তাঁরা দু’জন দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। শামীম হলেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক মাস কারাগারে কাটানোর পর জামিনে বের হন তিনি। তবে ফরিদপুরে এখন তাঁর যাতায়াত নেই। আর বিল্লাল হোসেন ছিলেন শ্রমিক লীগের নেতা। তিনি ‘মুরগি বিল্লাল’ নামে পরিচিত। সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহ্তেশাম হোসেন বাবরের ব্যক্তিগত সহকারীর মতো ছিলেন বিল্লাল। বাবরের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বিল্লাল। নতুন করে যে অভিযোগপত্র দাখিল হচ্ছে, তাতে শামীম ও বিল্লালের নাম থাকছে। আদালতে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বিল্লাল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া ছাড়াও আরও তিনজনের জবানবন্দিতে তাঁর নাম ছিল। তাঁরা হলেন- রুবেল, বরকত ও শামীম। দ্বিতীয় দফা তদন্তের পর আরও যাঁরা আসামি হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরী, সাবেক পৌর মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথু, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অনিমেষ রায়, ফরিদপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোকাররম মিয়া বাবু, জেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি ও জেলা মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মো. নাছির, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় সম্পাদক দীপক মজুমদার, ঈশান-গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম মজনু ও কানাইপুরের ইউপি চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এর বাইরে আরও কয়েকজনের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁদেরও অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হবে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- ঠিকাদার খন্দকার শাহিন ওরফে পান শাহিন, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সাহেব সরোয়ার, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জীবন, সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের তৎকালীন এপিএস অ্যাডভোকেট সত্যজিৎ মুখার্জি, ব্যবসায়ী আজমল হোসেন খান ওরফে ছোট আজম, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা খলিফা কামাল উদ্দিন, চৌধুরী হাসান ও হারুন মণ্ডল। আদালতের এপিপি মো. মাহবুবুল হাসান সমকালকে বলেন, আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এখন মামলাটি অন্য আদালতে রয়েছে।
প্রথম অভিযোগপত্রে যাঁরা আসামি :বরকত-রুবেল ছাড়া প্রথম দফার অভিযোগপত্রের অন্য আসামিরা হলেন- ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, আসিকুর রহমান ফারহান, খন্দকার মোহ্তেশাম হোসেন বাবর, এএইচএম ফোয়াদ, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ওরফে ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলী মিনার ও তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম। ২০২০ সালের ২৬ জুন রাজধানীর কাফরুল থানায় অর্থ পাচারের অভিযোগে বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে সিআইডির পরিদর্শক এসএম মিরাজ আল মাহমুদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনী-২০১৫-এর ৪ (২) ধারায় এ মামলা করা হয়। এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফরিদপুরের এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত-রুবেল। এ ছাড়া মাদক কারবার, ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাঁরা। এসি, নন-এসিসহ ২৩টি বাস, ট্রাক, বোল্ডার, পাজেরো গাড়ির মালিক হয়েছেন। টাকার একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেন এই সহোদর। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ মামলায় এ দুই ভাইয়ের নাম বেশি প্রচার পেয়েছিল।
এজাহারে আরও বলা হয়, প্রথম জীবনে এ দুই ভাই রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে এক বিএনপি নেতার ফরমায়েশ খাটতেন। তখন তাঁদের সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। পরবর্তী সময়ে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন করেছেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ :আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মামলার অভিযোগ শুনানির সময় দেখা যায়, তদন্তকারী সংস্থা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অভিযোগপত্রের ৭১ নম্বর পাতায় তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আবেদন করেন। আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, অভিযোগপত্র জমা দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রাখার আবেদন থেকে স্পষ্ট- পূর্ণাঙ্গ তদন্ত না করেই তা দাখিল করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটির অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন আদালত। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার নিচে নন, এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে আদালত সিআইডিপ্রধানকে বলেছেন।
প্রথম দফায় তদন্তের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট এমন এক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হলে আদালত গ্রহণ না করে ফেরত পাঠাবেন- এমন শঙ্কার কথা বলা হলেও সিআইডির নীতিনির্ধারকরা তা আমলে নেননি। তবে এ মামলায় ছয়জনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ মামলায় জবানবন্দির নজির কম।
সার্বিক বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অর্থ পাচার মামলায় কোনো ধরনের ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। প্রভাবশালী ও বিত্তশালী অনেকে তদন্ত কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করতে পারেন। মামলার তদন্ত সঠিক পথে রয়েছে কিনা- বিভিন্ন পর্যায় থেকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ধরনের মামলার তদন্তে বিচ্যুতি হলে দেশের টাকা নিয়ে নয়ছয় ঘটতেই থাকবে।
সাহাদাত হোসেন পরশ