চার বছর বয়সী দুই কোমলমতি শিশু। সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো বোন। মনের আনন্দে ঘরে খেলা করছিল তারা। একপর্যায়ে বারান্দায় খাটের নিচে পড়ে থাকা পলিথিনে মোড়ানো একটি তেলাপোকা ও মাছি মারার বিষের প্যাকেট তাদের চোখে পড়ে। প্যাকেটটি নিয়ে বিষ খেয়ে ফেলে দুই শিশু। মুহূর্তেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দুই শিশু।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবারের দুপুরে এ ঘটনা ঘটেছে। অসাবধানতা ও অসচেতনতার কারণে দুই শিশুর এমন মৃত্যু পরিবার থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। কান্না থামছে না পরিবারের সদস্যদের।
ওই দুই শিশুর নাম ফাতেমা বেগম (৪) ও জান্নাত আক্তার (৪)। তারা মামাতো-ফুফাতো বোন। ফাতেমা উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের বারপাকিয়া এলাকার বাক্প্রতিবন্ধী মো. ইলিয়াস ও শারীরিক প্রতিবন্ধী চায়না বেগমের মেয়ে। জান্নাত একই এলাকার আবুল কাশেমের মেয়ে। প্রতিবন্ধী হওয়ায় বোনসহ তাঁর স্বামী-সন্তানকে আবুল কাশেম দেখাশোনা করেন।
দুই শিশুর দাদি ও নানি রহিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দুজন সারা দিন একসঙ্গে গড়াগড়ি করত। কিছু পাইলে একজন আরেকজনকে খাওয়াইত। খাটের নিচ থেইক্যা তেলচুরা (তেলাপোকা) মারা ওষুধরে আচার মনে কইরা খাইয়্যা ফেলছে। একটা খাইয়্যা আরেকটারে দিছে। খাইবার পরপর তাদের চোখ-মুখ যেন কেমন হইয়া গেছে। আমরা জাদু গেছে গা। আমি অহন কী করুম?’
এর আগে ৪ জুন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্কুলপড়ুয়া দুই ভাই শাহিল মোবারত জায়ান (৯) ও তার বড় ভাই শায়েন মোবারত জাহিনের (১৫) মৃত্যু হয়। একটি পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বাসায় ডেকে তেলাপোকা মারার ওষুধ স্প্রে করান তাদের মা–বাবা। কর্মীরা ছয় ঘণ্টা পর ঢুকে পুরো বাসা পরিষ্কার করে বসবাস করতে তাদের বলেছিলেন। পরিবারটি বাইরে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়ে দুই শিশু। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়।
সরাইলে নিহত দুই শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, খেলাধুলার একপর্যায়ে শিশু দুটি তেলাপোকা মারার বিষ খেয়ে ফেলার পর বিষয়টি দেখে চিৎকার দেন শিশুদের দাদি ও নানি রহিমা বেগম। পরে স্বজনেরা তাদের উদ্ধার করে প্রথমে অরুয়াইলের একটি ফার্মেসিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাদের মামা-চাচা আনোয়ার হোসেন মোটরসাইকেলে করে সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে শিশু ফাতেমাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। অবস্থার অবনতি হলে অক্সিজেন দিয়ে অপর শিশু জান্নাতকে গুরুতর অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা। বেলা আড়াইটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছালে জান্নাতকেও মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
সরাইলে চকলেট মনে করে তেলাপোকা মারার বিষ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু
সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নোমান মিয়া বলেন, তেলাপোকা মারার ওষুধ খাওয়ার পরিমাণের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে। দুই শিশুই খাওয়ার পরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে। নিয়মানুযায়ী খাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে পাকস্থলী ওয়াশ করতে পারলে রোগীকে বাঁচানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অরুয়াইল আবদুস সাত্তার ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এলাই মিয়া বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। শিশুরা সামনে যা পাবে তা–ই খাবে। এই মৃত্যু সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা আনতেই হবে। তা না হলে এ ধরনের মৃত্যু আরও ঘটবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বলেন, যেকোনো ওষুধ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। বিষ ও কীটনাশকজাতীয় মরণঘাতী ওষুধ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঘরে রাখতে হবে। আর যাঁরা এসব ওষুধ বিক্রয় বা বিপণন করেন, তাঁদেরও সতর্ক হতে হবে, যাতে সবার কাছে এসব বিক্রয় না করেন। তিনি বলেন, বিষজাতীয় ওষুধ প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে রঙের দিক দিয়ে ব্যতিক্রম হতে হবে। লাল রঙের হলে ভালো। বিষজাতীয় ওষুধে আলাদা করে লাল রং বা বিশেষ সতর্কতা সংকেত বা কোনো চিহ্ন থাকলে ভালো।