সাগরতলে শস্য ফলে

0
134
ইতালির নোলি উপকূলে সমুদ্রের তলদেশে নিমো’স গার্ডেন

ভবিষ্যতে আর কোথায় কোথায় ফসল চাষাবাদ করা যেতে পারে? এ প্রশ্ন করলে কেউ কেউ আকাশচারী পরিকল্পনার কথা বলতে পারেন। বলতে পারেন, মঙ্গল গ্রহে ভবিষ্যতের চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু ইতালির একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, এই পৃথিবীতেই আবাদযোগ্য বিস্তৃত অব্যবহৃত জায়গা রয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ চাষাবাদের সেই জমি হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশ।

ইতালির ওশান রিফ গ্রুপ এ উদ্দেশ্যে শুরু করেছে নিমো’স গার্ডেন নামের একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় তারা পানির নিচে খামার করেছে। পানির নিচে এটিই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম খামার, যেখানে স্থলভূমির গাছপালার আবাদ করা হচ্ছে।

বাগানটি করা হয়েছে ইতালির নোলি উপকূলে সাগরের তলদেশে। ভাসমান, স্বচ্ছ ও গম্বুজ আকারের গ্রিনহাউসের বিন্যাসে নানা প্রজাতির গাছগাছালি আর খাদ্যশস্যের উদ্ভিদ নিয়ে বানানো হয়েছে বাগানটি। বাগানকে সমুদ্রের তলদেশে নোঙর করে রাখা হয়েছে।

বাগানের সহপ্রতিষ্ঠাতা লুকা গাম্বেরিনি বলছেন, এই প্রযুক্তির লক্ষ্য হলো কৃষিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা; পরিবেশের ক্ষতি না করে স্থিতিশীলভাবে পৃথিবীর বিশাল উপকূলরেখায় চাষাবাদের একটি বাড়তি সম্ভাবনা তৈরি করা।

ডাইভিং সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক ওশান রিফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সার্জিও গাম্বেরিনি। তিনি লুকার বাবা। পানির নিচে বাগান করার ধারণাটি প্রথম আসে সার্জিওর মাথা থেকে।

২০১২ সালে প্রথমে এ প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল পানির নিচে একটি বেলুনের ভেতর পুদিনাগাছ লাগানোর মাধ্যমে। গত এক দশকে এই বাগানের পরিসর অনেক বেড়েছে।

ধারণা করা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ হাজার কোটিতে। এই বিপুল জনতার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে বলে জাতিসংঘের ধারণা।

লুকা বলেন, ‘আমাদের ভূমি ও সম্পদ সীমিত। এই সম্পদ সংগ্রহে আমাদের ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল নয়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রথাগত কৃষির বদলে পানির নিচে চাষাবাদ আমাদের কিছু বাড়তি সুবিধা দেবে।’

৬ থেকে ১০ মিটার পানির নিচে বাগানটি ভাসমান থাকে বলে জানান লুকা। তিনি বলেন, এই বাগানের সবচেয়ে বড় সুবিধা, গাছপালা বাইরের সব রকম রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে। এ ছাড়া সমুদ্রের পানির তুলনামূলক স্থিতিশীল তাপমাত্রা উদ্ভিদের জন্য বেশ আদর্শ।

পানির নিচের এই বাগান হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে করা হয়। এই কৌশলে উদ্ভিদ মাটির বদলে পানি থেকে পুষ্টি আহরণ করে। এই পদ্ধতিই বেশির ভাগ ইনডোর ভার্টিক্যাল খামারে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে সূর্যের আলো গাছপালা পর্যন্ত পৌঁছায়। প্রয়োজনে সম্পূরক আলো ব্যবহার করা হয়।

লুকা বলেন, বাগানের সবকিছু ক্যামেরা ও সেন্সরের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। বাগানের ব্যবস্থাপনা বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করা সম্ভব। ফসল কাটার সময় হলে একজন ডুবুরি তা কেটে থলেতে রাখবেন, পরে সাগরের তলদেশ থেকে ভাসিয়ে ওপরে নিয়ে আসবেন।

জলতলের এই বাগানের ব্যাস মাত্র দুই মিটার বলে জানান লুকা। তিনি বলেন, এ কারণে এখন এখানে ভুট্টা বা গমের মতো বড় আকারের ফসল চাষ করা যায় না। তবে এখানে ৭০ থেকে ১০০টি ছোট আকারের গাছের চাষ করা যায়।

লুকা বলেন, ‘আমরা স্ট্রবেরি থেকে টমেটো, মটরশুঁটি এবং অবশ্যই ভেষজজাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির শত শত উদ্ভিদ চাষের বিষয়টি এখানে পরীক্ষা করেছি।’

নিমো’স গার্ডেনের ফার্মাসিউটিক্যাল থেকে রান্নাবান্না নিয়ে প্রকৃতির ওপর একাধিক গবেষণা হয়েছে। ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই বাগানের পুদিনায় তেলের ঘনত্ব বেশি। এতে অনেক বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।

লুকা বলেন, এই জলজ খামার সমুদ্রের প্রাণীকে বিরক্ত করে না, বরং তাদের আকৃষ্ট করে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, আশপাশের তুলনায় এই বাগানের আশপাশে মাছের উপস্থিতি ৫৮ শতাংশ বেশি।

লুকা বলছিলেন, অধিকাংশ প্রযুক্তি ভবিষ্যৎ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, সমুদ্র উপকূল ধরে ভবিষ্যতে নিমো’স গার্ডেনের অনেক বাগান হবে। এই অঞ্চলের মানুষ এসব বাগান থেকে অনেক সুবিধা পাবেন।’

লুকা আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা আমরা যেভাবে করতে পারি, সাগরের তলদেশে এ ধরনের খামার তার উত্তর নয়। তবে আমরা প্রত্যাশা করছি, এই অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনের কথা ধরলে এটি তো অবশ্য একটি সূচক হতে যাচ্ছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.