ম্যাচটা ছিল দিবারাত্রির। ডিশ সংযোগ ছিল না যাঁদের কিংবা অ্যানটেনা ঘুরিয়ে ডিডি ন্যাশনাল আসত না, তাঁরা খবরটা জেনেছিলেন সম্ভবত বিটিভির রাতের সংবাদে। রেডিও থেকেও হতে পারে। যে যুগে ওয়ানডে জিততে লাগে আড়াই শ, সেই যুগে এটা ছিল বিরাট খবর।
ভিভ রিচার্ডস ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৮৯ করেছিলেন ১৯৮৪ সালে। ভিভের মতো লোক শেষ পর্যন্ত থেকেও যেহেতু ওই চূড়ার দেখা পাননি, মানুষেরও সম্ভবত তাই বিশ্বাসটা তখনো জন্মায়নি। নব্বইয়ের কিশোর কিংবা সবে তারুণ্যে পা রাখা প্রজন্মের তো আরও নয়। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে গ্যারি কারস্টেনের ১৮৮ তারা দেখেছে বটে, সেখানেও ব্যাটসম্যান শেষ পর্যন্ত থেকেও দুই শ রানের চূড়ার দেখা পাননি।
ওয়ানডেতে কেউ একা সর্বোচ্চ কিছু করলে ভিভ কিংবা কারস্টেনের আশপাশে থাকবে বড়জোর, কিন্তু দুই শ হয়তো কেউ পাবেন না—এমন বিশ্বাসে বিশ্বাসীর সংখ্যা তখন একেবারে কমও ছিল না। কারণ, কারস্টেন ছিলেন ওপেনার, প্রতিপক্ষ ছিল আরব আমিরাতের মতো শিক্ষানবিশ।
আর ভিভ? চারে নামলেও সেটা দুই ওপেনার মিলে ১৬ বল খেলার পর। প্রতিপক্ষও ছিল তাঁর পছন্দের, ইংল্যান্ড। আর স্ট্রোক মেকিংয়ে ভিভ তো ভিভই। তাঁর যেহেতু হয়নি, এক যুগ পর ধীরেসুস্থে খেলা কারস্টেনও পারেননি; অতএব দুই শ অজেয়, বিশ্বাসটা টিকে ছিল।
সাঈদ আনোয়ার সেই বিশ্বাসকে দুমড়েমুচড়ে ভেঙেছিলেন এক বছর পরই। জন্ম দিয়েছিলেন নতুন এক বিশ্বাসের। সেটা সংক্রমিতও হলো পরবর্তী প্রজন্মেও। আনোয়ারই প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু ক্রিকেটীয় শট খেলেই আরামসে দুই শ করা যায় এবং তা–ও মোটামুটি ওভার তিনেক হাতে রেখেই।
ক্রিকইনফোর আর্কাইভে সেই ইনিংসের বল বাই বল ব্রেকডাউন (আনঅফিশিয়াল) বলছে, ৪৬.৪ ওভারে আউট হন আনোয়ার, নামের পাশে ১৪৬ বলে ১৯৪। পরদিন ভারতের ৩৫ রানের হার ও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় ছাপিয়ে লোকের মুখে হা–হুতাশটাই বেশি ছিল। এত কাছে গিয়ে শেষমেশ নিরীহ টেন্ডুলকারকে সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে আউট! ‘টপ এজ’ হয়ে ওঠা আনোয়ারের ক্যাচটি সৌরভ গাঙ্গুলী কেমন অসামান্য দক্ষতায় নিলেন, সেই কথার চেয়ে বেশি শোনা গেল ‘না ধরলেই হতো’ কথাটি। পাড়ার উঠতি ক্রিকেটারদের চোখেমুখে কেমন ঝিলিকমাখা চাঞ্চল্য। দুই শ তাহলে সম্ভব!

সাকলায়েন মুশতাক ইউটিউবে তাঁর শোতে একবার বলেছিলেন কথাটা। ব্যাটিংয়ে আনোয়ারের পজিশনিং দেখে মনে হতো, বোলার কোথায় বল করবেন, সেটা তিনি আগেই জানতেন। বোলার প্রথম বলটি করার পর ওই ওভারের বাকি পাঁচটি বল আনোয়ারের ইচ্ছানুযায়ী ফেলতে বাধ্য হতেন—এমন কথাও বলেছেন সাকলায়েন। সহজ ভাষায় ব্যাপারটা সম্ভবত এমন যে আগেভাগেই লাইন-লেংথ বুঝে ফেলায় মনে হতো, আনোয়ারের ইচ্ছানুযায়ী বোলিং করছেন বোলার। আনোয়ারের ১৯৪ মহাকাব্যের প্রতিটি পাতাই এমন, দাবি সাকলায়েনের।
পাকিস্তানের সাবেক এই স্পিনার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রুমমেট হিসেবে পেয়েছেন আনোয়ারকে। বাকি সতীর্থদের মধ্যে সাকলায়েনের তাই আনোয়ারকে একটু বেশিই জানাবোঝার কথা। সাকলায়েনের একটা অদ্ভুত দাবি হলো, ওই ইনিংস খেলার আগের কয়েক দিনে আনোয়ার একটু অন্য রকম ছিলেন। মানে সবকিছুতে কেমন একটা দীপ্তি, ভেতরে-ভেতরে আগুন, বিশেষ করে নেটে। বোলারের লাইন-লেংথ আগেভাগেই বুঝে ফেলার মতো আনোয়ারও যেন টের পাচ্ছিলেন, কিছু একটা আসছে!
সাকলায়েন মুশতাক ইউটিউবে তাঁর শোতে একবার বলেছিলেন কথাটা। ব্যাটিংয়ে আনোয়ারের পজিশনিং দেখে মনে হতো, বোলার কোথায় বল করবেন, সেটা তিনি আগেই জানতেন।
শুনুন সাকলায়েনের মুখেই, ‘প্রথম বলটা তিনি বোলারের ইচ্ছানুযায়ী খেলবেন। পরের পাঁচটি তিনি যেখানে বোলারকে চান। তাঁর পজিশনিং এমন যেন জানেন বোলার কোথায় (বল) করবে। এর প্রমাণ ১৯৪ রানের ইনিংসে। ক্লিপ দেখলে বুঝবেন, প্রথম ডেলিভারির পর তিনি যেন জানতেন পরের পাঁচটি কোথায় হবে। সেটা হোক (অনিল) কুম্বলে, (জাভাগাল) শ্রীনাথ কিংবা (ভেঙ্কটেশ) প্রসাদ। প্রথমটি খেলার পর পরের পাঁচটিতে অনেক সময় পেয়েছেন (খেলার)।’
প্রশ্ন হলো, এই যে কিছু একটা এল এবং তাতে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের বিশ্ব রেকর্ড হলো, এর আগে আনোয়ার ঠিক কেমন ছিলেন? ‘দুসরা’র আবিষ্কারক বলেন, ‘১৯৪ রানের ইনিংসটির আগে কয়েক দিন তাকে খেয়াল করে বুঝলাম, তার ভেতরে অন্য রকম কিছু একটা ঘটছে। কেমন একটা স্ফুলিঙ্গ। নেটে অনেক সময় দিচ্ছে, প্রচুর কাজ করছে ব্যাটিং নিয়ে। ম্যাচ সিচুয়েশনের মতো ব্যাট করছে (নেটে)। চার থেকে পাঁচ দিন ধরে তাকে এভাবে (এনার্জি) ফুটতে দেখেছি। প্রস্তুতিও ছিল নিখুঁত।’
চেন্নাইয়ের সেই গরমে চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে আনোয়ারের কিছু শট এখনো অনেকের চোখ লেগে থাকার কথা। প্রসাদকে কবজির মোচড়ে ফ্লিক করে ছক্কা, রবিন সিংকে ফেস ওপেন করে মারা চার কিংবা চাবুকের মতো স্কয়ার কাটগুলো। সুনীল যোশীকে এগিয়ে এসে চার মেরে ৪৪ বলে ফিফটি, দলের রান যখন ৭৫। সেঞ্চুরি ৮৫ বলে দলের রান যখন ২৭ ওভারে ১৪৪/২।
ততক্ষণে আরও একটি কাণ্ড ঘটেছে। ১৮.৬ ওভার থেকে ক্রিজে আনোয়ারের রানার শহীদ আফ্রিদি। তখন অসুস্থতায় কিংবা চোটে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়কের অনুমতি সাপেক্ষে রানার নেওয়া যেত। প্রচণ্ড গরমে ক্রাম্প ও ক্লান্তির কারণে তাঁকে রানার নিতে হয়। আউট হওয়া পর্যন্ত আফ্রিদি দৌড়েছেন তাঁর জন্য। খুব বেশি পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়নি। ৫ ছক্কা ও ২২ চারের ইনিংসে ১১৮ রানই এসেছে বাউন্ডারি (চার-ছক্কা) থেকে। ৪১তম ওভারে কুম্বলেকে মারা টানা তিন ছক্কা এই ইনিংসের ‘আইসিং অন দ্য কেক’। সেই ওভারটা ছিল এমন—২, ২, ৬, ৬, ৬, ৪!
সাকলায়েনের ভাষায়, আনোয়ার এ ম্যাচে ‘যেভাবে ব্যাট করেছে যেন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। যেখানে খুশি সেখানে মারতে পারে।’ ভারতের অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন, তাঁর দেখা সেরা (ওয়ানডে) ইনিংস। এমন একটি ইনিংসের শিকড়টাও বলেছেন সাকলায়েন, ‘১৯৪ দেখার পর মনে হয়েছিল, এই ইনিংসের ৯ থেকে ১০ দিন আগে (সাঈদ ভাই) হয়তো স্বপ্নে দেখেছিলেন কিংবা মনস্থির করে রেখেছিলেন বিশ্ব রেকর্ড গড়বেন। কীভাবে ব্যাট করতে হয়, সেটা দেখাবেন বিশ্বকে।’

তবে বিশ্ব কিন্তু শুধু আনোয়ারের ইনিংসের প্রশংসাই করেনি, খুঁতও ধরেছে। নিউজিল্যান্ডের গ্লেন টার্নার টিভি ধারাভাষ্যেই বলেছিলেন, রানার থাকায় ইনিংসটি খেলা সহজ হয়েছে, বিশেষ করে চেন্নাইয়ের এমন গরমে। ম্যাচের আরেক ধারাভাষ্যকার ও ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার রবি শাস্ত্রী পরে হার্শা ভোগলের এক টিভি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি ভারতের অধিনায়ক থাকলে আনোয়ারকে রানার নিতে দিতেন না।
পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে আনোয়ারের কাছে রানার নেওয়ার কারণও জানতে চেয়েছিলেন সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকা শাস্ত্রী। আনোয়ার বলেছিলেন, ‘আমি শতভাগ ফিট নই। ৭৫ শতাংশ ফিট। আশা করি, ফাইনালের আগে শতভাগ ফিট হয়ে উঠতে পারব।’
কারণও বলেছিলেন আনোয়ার, ‘প্রচণ্ড গরম ছিল। আর্দ্রতাও সর্বোচ্চ পর্যায়ের। ৩০-৪০ রানে থাকতে মনে হচ্ছিল আউট হয়ে যাব। শহীদ আফ্রিদির অনেক কিছু প্রাপ্য। আমি বেশ ভালোই ভুগছিলাম। সে আমাকে সাহায্য করায় চালিয়ে যেতে পেরেছি।’
নির্দয়, নির্মম সেই চালিয়ে যাওয়ায় ভিভের ছাপ ছিল স্পষ্ট, থাকবে না কেন! ব্যাটিংয়ে আনোয়ার নিজের ঘরানা বেছে নিয়েছেন তো ভিভকে দেখেই। ছয় বছর পরে আরব নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই ইনিংস নিয়ে বলেছিলেন আনোয়ার। তত দিনে তাঁর জীবন অনেক পাল্টে গেছে, যেটা ২০০১ সালে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়ে বিসমাহকে হারানোর কারণে। ধর্মকর্মে মনোযোগ দিয়েছিলেন আনোয়ার। ১৯৪ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও তত দিনে পাল্টেছে, ‘আগে (দুই শ না পাওয়ায়) খারাপ লাগত। কিন্তু এখন আর লাগে না। সবকিছুই আল্লাহর হাতে। মনে আছে, ১৯৪ রানে পৌঁছানোর পর ভেবেছি, আর মাত্র ৬টি রান এবং তারপরই আউট হই। এর কারণ সম্ভবত আল্লাহর ওপর না, নিজের ওপর ভরসা রাখা।’
জীবনে এই অনুধাবন হওয়ার পর আনোয়ারের জীবন আর পাল্টায়নি। এখনো চলছে একই গতিপথে। এর মধ্যে পৃথিবীও অনেক পাল্টেছে। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের চার্লস কভেন্ট্রি বাংলাদেশের বিপক্ষে অপরাজিত ১৯৪ দিয়ে ছুঁলেন আনোয়ারকে। পরের বছর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি হলো ১২টি। রোহিত শর্মার একারই তিনটি।
মজার বিষয়, আনোয়ার যাঁর বলে আউট হয়ে ১৯৪ নিয়ে ফিরেছিলেন, সেই টেন্ডুলকারের কাছ থেকে প্রথম ডাবল দেখেছে ওয়ানডে। কিন্তু দুই শর ব্লুপ্রিন্ট কে এঁকেছেন, সেই প্রশ্নে লোকে আজও স্মরণ করে ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আয়োজন করা ইনডিপেনডেন্স কাপে আনোয়ারের সেই ১৯৪-কে, যেটা হয়েছিল আজের এই দিনে!
মেহেদী হাসান
ঢাকা