গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর দলীয় ফান্ডের কোনো হিসাবনিকাশ দেন না। পদ-পদবি বিক্রিসহ প্রবাসে কমিটি বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, ভিপি নুর সরকারের পক্ষে কাজ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, শুধু জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি নয়; সরকারবিরোধী যে কোনো প্ল্যাটফর্মের কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ পেলেই তিনি যাবেন। আগামী নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, এবার ফখরুদ্দীন মার্কা অকার্যকর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে না। আগামীতে ‘আসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হবে।
গণঅধিকার পরিষদের অভ্যন্তরে টানাপোড়েন সামনে রেখে গতকাল সোমবার সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দলটির প্রধান ড. রেজা কিবরিয়া এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে নিজ দলের সমস্যা, আগামী নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার, মার্কিন নতুন ভিসা নীতিসহ চলমান রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
আপনার সঙ্গে দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের সম্পর্কের টানাপোড়েনের শুরু কী নিয়ে?
ড. রেজা কিবরিয়া: প্রথমত, দলের মধ্যে টাকা-পয়সার হিসাব চাওয়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। নুর প্রবাসে কমিটি গঠনের ব্যাপারে নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন। অথচ দলের প্রধান হিসেবে আমাকে ওই পদ দেওয়ার কথা। দলীয় ফান্ডের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। কাউকে হিসাবনিকাশ দিতে চান না তিনি। আমি দলের প্রধান, কিন্তু আমাকে হিসাবনিকাশ দেন না। এখন আমি হিসাব চাওয়াতে তিনি আজেবাজে কথা বলছেন। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তিনি যে বৈঠক করেছেন; এটি কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই।
কী কারণে, কেন ওই বৈঠক করলেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন কেন? ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? তারা কি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে? নাকি ভিপি নুর টাকা পেয়েছেন? অবশ্য যাঁরা তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছেন তাঁরা জানিয়েছেন, বৈঠকের পর ‘কালো একটি ব্যাগ’ নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠেছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে তিনি কী করেছেন? নিজের স্বাক্ষরে কেন করেছেন– জানি না। আবার ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকের সঙ্গেও গোপন বৈঠক করেন। অথচ দলের আহ্বায়ক হিসেবে আমি তা জানি না। এসব কারণে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা যেত না?
ড. রেজা কিবরিয়া: ভিপি নুর এখন বড় নেতা হয়ে গেছেন! রাজনীতি বেশি বোঝেন! আমি তাঁর কথায় চলি না– এসব কারণে সংকটের সমাধান হবে না। আমি আইএমএফের বড় চাকরি ছেড়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। সারাজীবন হালাল টাকা-পয়সা রোজগার করেছি। এখন আমার দলের মধ্যে কেন আর্থিক অস্বচ্ছতা থাকবে– এটা তো মেনে নিতে পারি না।
দলের ভেতর পদ-পদবি কেনাবেচা করছেন ভিপি নুর। নুরকে গাড়ি দেবেন বলে কাতারে একজন প্রবাসীকে দলের সভাপতিও করেছেন। এ গুলো তো ঠিক না। শুনেছি, কয়েক দিন আগে ভিপি নুর আর্থিক সহায়তার জন্য একটি বড় শিল্প গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। যদি ঐ গ্রুপটি বড় অঙ্কের টাকা দেয়, তাহলে তিনি বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করবেন। সমাবেশটি আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন।
অবশ্য গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরসহ দলের নেতাদের অভিযোগ– আপনি ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ নামের সংগঠনের সব কর্মসূচিতে দলকে না জানিয়ে যোগ দিচ্ছেন। ভিপি নুর এও বলছেন, ‘বিএনপির একজন বহিষ্কৃত নেতার কমিটির সভায় তাঁদের দলের আহ্বায়ক উপস্থিত থাকবেন– এটা অপ্রত্যাশিত। এতে বিএনপির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ড. রেজা কিবরিয়া: সরকারবিরোধী যে কোনো দল ও সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচিতে আমি অতীতে ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকব। আমি ইনসাফ কমিটির কোনো পদ-পদবিতে নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত– যে ডাকবে, আমি সেখানে যাব।
দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী তৎপরতার কারণে সংগঠনটির সদস্য সচিব শওকত মাহমুদকে সম্প্রতি বিএনপি দলের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে। বিএনপি সংগঠনটিকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ও আঁতাত রয়েছে বলে সন্দেহ করছে। তা ছাড়া বিএনপি চায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার। আর সংগঠনটি চায় জাতীয় সরকার। এসব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।
ড. রেজা কিবরিয়া: ইনসাফ কমিটিও নির্বাচনকালীন সরকার চায়। ‘জাতীয়’ আর ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ শব্দচয়নে হেরফের হতে পারে। হয়তো বিষয়টি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ইনসাফের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, যে দলের মাধ্যমে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, সে দলকে নিয়ে নির্বাচনকালীন জাতীয় বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে পারে না। তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যে নামেই হোক– নির্বাচনকালীন সরকারে আওয়ামী লীগ থাকতে পারবে না।
গণঅধিকার পরিষদের রোববার রাতের বৈঠকে আপনি একই কথা বলেছেন– সরকারবিরোধী যে কোনো প্ল্যাটফর্ম আমন্ত্রণ জানালে যোগ দেবেন। অবশ্য ওই বৈঠকে আগামী জুলাই মাসে দলের কাউন্সিল ডাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাউন্সিলেই দলের নেতাকর্মীর মতামতের ভিত্তিতে আপনাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ বেরিয়েছে।
ড. রেজা কিবরিয়া: ওই বৈঠকে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভিপি নুর মিথ্যা কথা বলছেন। অর্থ লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলছেন। নুরের নেতৃত্বে দলের ছোট একটি অংশ এসব বলতে পারে। দলের বড় অংশ আমার সঙ্গে রয়েছে। দলের অনেক নেতাই দুঃখ প্রকাশ করে বলছেন, দলের মধ্যে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকে, তাহলে কীভাবে আমরা প্রমাণ করব– আওয়ামী লীগের চেয়ে আমাদের দল ভালো কিছু করবে?
ইনসাফ কায়েম কমিটি নিয়ে মতবিরোধ ছাড়াও গত এক বছর ধরে ভিপি নুরের সঙ্গে আপনার দূরত্ব বেড়েছে। এ কারণে গণঅধিকার পরিষদের কর্মসূচিতে আপনাকে তেমন দেখা যায়নি। এমনকি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও আপনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
ড. রেজা কিবরিয়া: আমার বিচার-বিবেচনার সঙ্গে তো নুরের বিচারবোধ এক হতে পারে না। আমার বয়স, অভিজ্ঞতা তাঁর চেয়ে বেশি। তিনি যে লেভেলে বড় হয়েছেন, সেই লেভেলেই চিন্তা করবেন। এটিই স্বাভাবিক। আমি বাংলাদেশে এসেছি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য; রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে। আমি তো নুরের মতো পরিবার থেকে আসিনি। তাঁর কাছ থেকে আমার শেখারও কিছু নেই। তবে এখন আমার অনুমতি ছাড়া কোনো বৈঠক হবে না। আমি চিঠি ইস্যু করেছি। নুর দলকে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আপনি কি তাঁকে (ভিপি নুর) সন্দেহ করছেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: তিনি কীভাবে কাজ করবেন, জানি না। আমার মনে হয়, তিনি সরকারের পক্ষে কাজ করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেই এসব খবর পেয়ে যাব, কারা কার পক্ষে কাজ করেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কি শেষ পর্যন্ত গণঅধিকার পরিষদ ভাঙনের কবলে পড়বে?
ড. রেজা কিবরিয়া: ভাঙতেও পারে। হলেও এটি সরকারি দলের চেষ্টায় হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে আপনাদের দল বেরিয়ে গেল কেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: দলের সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে ৪৫ জন নেতা গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে কথা বলেছেন। সবাই নেতিবাচক ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে থেকে লাভ নেই। আমাদের লক্ষ্য আর তাঁদের লক্ষ্য এক নয়। তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না– ইত্যাদি বক্তব্য ছিল সবার।
ভবিষ্যতে অন্য কোনো জোটে যোগ দেবেন কিনা?
ড. রেজা কিবরিয়া: এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। সময়ই বলে দেবে, কোন জোটে যাব।
এ পরিস্থিতিতে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ড. রেজা কিবরিয়া: আপাতত দলে আছি, দলে থাকব। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। গণঅধিকার পরিষদ নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। আশা করি, আমরা নিবন্ধন পাব।
যেসব দল দেশ পরিচালনা করেছে, তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. রেজা কিবরিয়া: কয়েকটি পরিবারের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি বন্দি হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি– সবাই পরিবারতন্ত্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। একনায়কত্ব চলছে। তারা কীভাবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবে? পরিবারতন্ত্র ভাঙা প্রয়োজন। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতসহ আমাদের দলে পরিবারতন্ত্র নেই। হুট করে এ প্রবণতা থেকে বের হওয়া কঠিন। আস্থা আনতে হবে।
মার্কিন নতুন ভিসা নীতিতে আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: এটা বর্তমান সরকারের জন্য বড় একটা হুমকি। নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব পড়বেই। যারা সরকারের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারে কাজ করেছে বা করবে– তাদের ভোগ করার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা কারচুপিতে সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রত্যেকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাদের বউ-বাচ্চাদের আমেরিকায় পাঠাতে পারবে না। বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনতে পারবে না। আমেরিকার সঙ্গে ১৮০টি দেশ এই নীতিমালা অনুসরণ করবে।
বিদেশি চাপের ফলে কি আওয়ামী লীগের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে?
ড. রেজা কিবরিয়া: আওয়ামী লীগ বিগত দুটি নির্বাচনে প্রমাণ করেছে– তাদের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে কোনো আলোচনা হতে পারে?
ড. রেজা কিবরিয়া: এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে ভারত বুঝে গেছে, আওয়ামী লীগ এখন ঘৃণিত সরকার। দু’বার জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। এদের সঙ্গে আর থেকে লাভ নেই। ভারত অনেক চালাক দেশ।