সমালোচনার পরও ভারতের গণতন্ত্রের প্রশংসায় বাইডেন

0
213
রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে বক্তব্য দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে

যুক্তরাষ্ট্র সফরে বিরল সম্মান পেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নয়াদিল্লির সঙ্গে আরও জোরালো সম্পর্কের আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু ভারতের দুর্বল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কিছু বললেন না। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট–এ লিখেছেন টলিউস ওলোরুনিপা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশংসা করলেন। একই সময়ে কড়া সমালোচনা করলেন চীনের। প্রশংসা করলেন ভারতের এমন একজন নেতার, যাঁর বিরুদ্ধে নিজ দেশে ব্যাপক নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।

গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে দুই নেতার মধ্যে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তাঁরা। সেখানে ভিন্ন মতাবলম্বী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর মোদি সরকারের দমন–পীড়নের বিষয়ে মানবাধিকার গ্রুপগুলোর অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারত ও চীনের মধ্যে তুলনা করলেন। মানবাধিকার প্রশ্নে চীনের তুলনায় ভারত কতটা উঁচুতে সেটা বললেন। সম্প্রতি তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে ‘স্বৈরশাসক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র–চীনের সম্পর্ক আর যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের সম্পর্কের জায়গা এক রকম নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত—দুই দেশই গণতান্ত্রিক। আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।’

বাইডেন বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের চরিত্র একই। একইভাবে আমাদের বৈচিত্র্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সারল্য, সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদও প্রায় অভিন্ন।’

সংবাদ সম্মেলনে বাইডেনের পাশাপাশি মোদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্য টেনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ডিএনএতে রয়েছে গণতন্ত্র। তিনি বলেন, তাঁর দেশের মূল্যবোধ হচ্ছে জাতপাত, ধর্মীয় বিশ্বাস, বয়স বা যেকোনো ধরনের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কারও প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্য করা হয় না।

চীনের ক্ষেত্রে কঠোর, ভারতের ক্ষেত্রে নরম

বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্টকে ‘স্বৈরশাসক’ বলতে গিয়ে মোটেই সুর নরম করলেন না। যুক্তরাষ্ট্র–চীনের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, তিনি মনে করেন, সির বিষয়ে এটাই হচ্ছে আসল কথা। এ কথা থেকে তিনি নড়ছেন না। তাঁর এই বক্তব্যে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে, এমন অনুমান খারিজ করে বাইডেন বলেন, তিনি সির সঙ্গে শিগিগরই সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করছেন। তিনি মনে করেন, তাঁর মন্তব্যের ‘প্রকৃত কোনো পরিণতি নেই’।

অধিকাংশ মানবাধিকার গ্রুপ চীনকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে দেখে থাকে। অন্যদিকে ভারতকে তারা এখন দেখে থাকে ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে। এই দেশের নেতারা ক্রমশ বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে চায়। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের মধ্যে লড়াইয়ে বাইডেন যে মোদিকে পাশে চান, সেটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রশংসাবান থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সহকর্মীরা বলছেন, মোদির রাষ্ট্রীয় সফরের সময় তাঁকে নিয়ে বাইডেনের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। মোদির সঙ্গে তাঁর সাড়ম্বরপূর্ণ সাক্ষাৎ এবং প্রযুক্তি, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে বেশ কয়েকটি চুক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে দিন দিন ভারতের ভূমিকা বাড়ছে। এ অবস্থায় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার যে একটা আকাঙ্ক্ষা ওয়াশিংটনের রয়েছে, সেটা গোপন করেননি বাইডেন।

মোদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর দেশের অবস্থানকে আরও জোরালো করতে চান। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলছে, মোদির এই আকাঙ্ক্ষায় আদতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও জড়িত। বৃহস্পতিবার মোদি ওভাল অফিসে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন।

রাশিয়ার নিন্দা জানালেন না

কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের ভাষণে মোদি কোনো দেশের নামোল্লেখ না করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে বলেন, জবরদস্তি ও মুখোমুখি অবস্থানের অন্ধকার ছায়া ইন্দো–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।

চীনের বিরুদ্ধে কথা বললেও ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে মোদি কিছু বললেন না, কোনো নিন্দা জানালেন না। মার্কিন কর্মকর্তারা নিশ্চয় তাঁর মুখ থেকে রাশিয়ার বিষয়ে কিছু শুনতে চেয়েছিলেন। তিনি শুধু বললেন, ‘আমি এখন সরাসরি এবং প্রকাশ্যে বলছি, এখন যুদ্ধের যুগ নয়। এখন সংলাপ ও গণতন্ত্রের যুগ। এখন রক্তপাত বন্ধ ও মানুষের ভোগান্তি লাগবে যা যা করা দরকার, আমাদের অবশ্যই তা–ই করতে হবে।’

বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মোদি তৃতীয় কোনো নেতা, যাঁকে হোয়াইট হাউসে এত সাড়ম্বরে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। এর আগে রাষ্ট্রীয় সফরে মোদির মতোই সম্মান জানানো হয়েছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়োলকে। ২০১৬ সালে তাঁরাও কংগ্রেসে ভাষণ দিয়েছিলেন। তবে হাতে গোনা কয়েকজন নেতার মধ্যে মোদিই একজন, যাঁকে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দ্বিতীয়বার ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

মোদি তাঁর ভাষণে ভারত যে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ, সেটা বারবার বলেছেন। আপাতদৃষ্টে সমালোচনার জবাব এভাবে দিলেন তিনি।

যৌথ অধিবেশনে মোদি প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার কেভিন ম্যাককার্থির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে আমি একটি বিষয় বলতে পারি, আপনাদের কাজটা অনেক কঠিন। তবে বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্রের দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক উদ্‌যাপনে আজ আপনাদের একসঙ্গে দেখে আমি আনন্দিত।’

কংগ্রেসের দুই কক্ষের সদস্যদের মাঝেমধ্যেই মোদির প্রশংসা করতে দেখা গেছে। এ সময় কংগ্রেসের গ্যালারিতে আগত অতিথিরা ‘মোদি’, ‘মোদি’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। ইতিপূর্বে সেখানে মোদির আগমনের পর হাজার হাজার সমর্থকের স্লোগানের মধ্যে বাইডেন মোদিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে ‘অসীম সম্ভাবনা’ দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

এ সময় বাইডেন বলেন, ‘দুই মহান রাষ্ট্র, দুই মহান বন্ধু ও দুই বিরাট শক্তি একবিংশ শতাব্দীর ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।’

বাইডেন ও মোদি ভারতে যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি, মাইক্রোচিপ তৈরির কারখানায় মার্কিন বিনিয়োগসহ অন্যান্য চুক্তির ঘোষণা দেন। তাঁরা ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র বেঙ্গালুরু ও আহমেদাবাদে দুটি কনস্যুলেট খুলবে। অন্যদিকে ভারত সিয়াটলে খুলবে কনস্যুলেট।

ভারত ও চীনের মধ্যে তুলনাও এখানে উঠে আসে। কারণ, সম্প্রতি বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এর আগে অনানুষ্ঠানিক একটি মন্তব্য করেছিলেন।

ক্যালিফোর্নিয়ায় এক নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে বাইডেন গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের সন্দেহজনক বেলুন ধ্বংসের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, সি এই বিষয় নিয়ে খোদ তাঁর সরকারকে অন্ধকারে রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটিই হচ্ছে স্বৈরশাসকদের জন্য বড় ধরনের এক বিব্রতকর মুহূর্ত—যখন তাঁরা জানেন না আসলে কী ঘটেছে।’

এভাবে তাদের নেতাকে তুলে ধরায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চীন। তারা বলেছে, ‘এটা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য।’ এরপরও হোয়াইট হাউস এই বক্তব্য থেকে সরে আসেনি।

কংগ্রেসে পাঁচজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। নাটকীয়ভাবে সেই কথা তুলে ধরে মোদি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ রয়েছে, যাঁদের শিকড় প্রোথিত ভারতে। তাঁদের মধ্যে সম্ভবত কয়েকজন আজ এই চেম্বারে রয়েছেন। আর একজন রয়েছেন আমার পেছনে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বাড়বে।’

অন্যদিকে বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, মোদির সঙ্গে একান্তে বৈঠকে তিনি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, দুই দেশই এসব বিষয়ে ‘চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলা করছে।

মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ আমলে আসেনি

মানবাধিকার গ্রুপ, কংগ্রেস সদস্য ও অন্যদের উদ্বেগ সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি বাইডেন। এঁরা সবাই মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে তাঁর শক্ত অবস্থান দেখতে চেয়েছিলেন।

উদাহরণস্বরূপ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী ও ঘৃণা ছড়ানোসংক্রান্ত আইনে অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শান্তিকামী প্রতিবাদী ও অন্যান্য সমালোচকের বিচার করছে’। সংস্থাটি বলছে, মোদি সরকার ‘এমন সব আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষে বৈষম্যমূলক’।

মানবাধিকারকর্মীরা আরও বলছেন, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ধর্মান্ধতার বিস্তার হয়েছে, বাক্‌স্বাধীনতায় আক্রমণ হয়েছে। তাঁরা বলছেন, একধরনের দায়মুক্তি এসব কর্মকাণ্ডে হিন্দুত্ববাদীদের উৎসাহিত করেছে। তাঁরা বলছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও তাদের প্রতিবেদন ও বিবৃতিতে এসব বিষয় উল্লেখ করেছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে।

তবে মোদি ভারতে ব্যাপক হারে গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তিনি বিস্মিত যে তাঁর দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের কথা বলে সমালোচকেরা এসব কথা বলছে। ভারত প্রমাণ করেছে, সেখানে গণতন্ত্রে জাতপাত–মত–ধর্মীয় বিশ্বাস–লিঙ্গনির্বিশেষে সবাই সমান।

মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসার আগে কংগ্রেসের ৭০ জনের বেশি সদস্য এক চিঠিতে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি যেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, ইন্টারনেট বন্ধ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ এবং অন্যান্য ‘অস্বস্তিকর লক্ষণ’ নিয়ে কথা বলেন।

কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য যৌথ অধিবেশনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা বর্জন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ইলহান ওমর ও রাশিদা তালিব (ডেমোক্র্যাট)। তাঁরা দুজনই মুসলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.