সেবার সম্মেলনে হেনিংয়ের আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একনজর দেখা। যাঁর কথা হৃদয়ে ধারণ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি, তিনি কেমন? এই প্রশ্ন ছিল হেনিংয়ের মনে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য ছবি তুলেছিলেন। তাঁর তোলা সেসব ছবি নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘উইটনেসিং হিস্ট্রি ইন দ্য মেকিং: ফটোগ্রাফস বাই অ্যান ডি হেনিং’ শিরোনামে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ, শরণার্থীদের আশ্রয় গ্রহণের আকুতি এবং ধ্বংসের চিত্র ফুটে ওঠে হেনিংয়ের ছবিতে। এ সময় বারবার বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব ছিল না। পরে তিনি এসেছিলেন ১৯৭২–এ, স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে। এবার আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে দেশে এসে প্রথম সম্মেলনে দেখা কিছু ঘটনা তুলে ধরলেন হেনিং।
১৯৭২–এর সম্মেলনটি ছিল আওয়ামী লীগের নবম সম্মেলন। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭০ বছরে ২১টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নয়বার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আর চারবার করে সভাপতি হয়েছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। নতুন এ রাজনৈতিক দলের প্রথম সম্মেলন হয় ঢাকার ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে। এতে সভাপতির দায়িত্ব পান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৫৩, ৫৫ এবং ৫৭ সালে দলের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
১৯৭২ সালে হেনিং আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যে ছবিগুলো তোলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে হত্যার পর সেই সব নষ্ট করে ফেলে ঘাতক বাহিনী। কিন্তু এমন শক্তিশালী এক নেতৃত্বের চিহ্ন মুছে ফেলা এত সহজ নয়। প্রায় ৫০ বছর আগে তোলা বঙ্গবন্ধুর এসব রঙিন ছবি আবারও সামনে নিয়ে আসেন অ্যান ডি হেনিং।
সেই সম্মেলনে কী করে আসা হলো ঢাকায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে হেনিং বলেন, ১৯৭২ সালে কলকাতা সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় আসেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হেনিং বলেন, ‘আমি তখন [১৯৭২] কলকাতায় ছিলাম এবং একজন বন্ধু আমাকে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুষ্ঠানটি কাভার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল সভা। তাই আমি এসে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম।’
অ্যান ডি হেনিং বলেন, ‘আমার মনে আছে, মঞ্চে শেখ মুজিবকে দেখেছিলাম। আমি তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে তাঁর কাছাকাছি বসে থাকতে দেখেছি। সেই সঙ্গে অন্য একজনকেও দেখেছি, আমাকে পরে বলা হয়েছিল এই লোকটি [খন্দকার মোশতাক আহমদ], যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।’
তিনি কাউন্সিলের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এটি একটি অবিশ্বাস্য মুহূর্ত ছিল। আমি তাঁর [বঙ্গবন্ধুর] ছবি তুললাম এবং আমি তাঁর কণ্ঠের তীব্রতা, আকর্ষণ ও ক্যারিশমা উপলব্ধি করলাম…সেখানে এক বিশাল জনসভা ছিল। সম্পূর্ণ নীরব। তাঁর কণ্ঠ মুগ্ধ হয়ে শুনছিল সবাই।’
হেনিং বলেন, আমি আজ (সোমবার) ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের একটি রেকর্ডিং শুনেছি। সম্মেলনে ভাষণে সেই একই তীব্রতা ও আকর্ষণ ছিল।
গত মঙ্গলবার সকালে অ্যান ডি হেনিং গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান। যেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র ও সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের সঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ৫০ বছর আগে বাংলাদেশে আসা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণা করেন তিনি।