আমদানি শুল্কে ছাড় ঘোষণার পরও নিয়ন্ত্রণহীন রয়ে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে শাক-সবজি ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই।
শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) কেরানীগঞ্জের আগানগর, জিনজিরা এবং রাজধানীর নয়াবাজার ও কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।
সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক কমিয়ে বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে শুক্রবার বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আরও আগেই শুল্ক কমানো উচিত ছিল। এখন কমিয়ে তেমন একটা কাজ হবে না। আর ক্রেতারা বলছেন, অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু আমদানি শুল্ক কমালেই চলবে না, তদারকি জোরদার করতে হবে এর পাশাপাশি।
এদিকে রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম ঘাম ধরাচ্ছে ক্রেতা সাধারণের কপালে। এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে আটা-ময়দা, ডাল-ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের দাম। দাম নিয়ন্ত্রণে চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অথচ শুক্রবার বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকায়। ছোলার পাশাপাশি বাড়ছে অন্যান্য ডালের দামও। গত একমাসের মধ্যে এসব পণ্যের দাম ১০-৩০ টাকা বেড়েছে।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে খোলা আটা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, প্যাকেট আটা ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা, খোলা ময়দা ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭০ টাকা ও প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি তো বাজার থেকেই উধাও!
এরই মধ্যে আকাশ ছুঁয়েছে খেজুরের দাম বাজারে প্রতি কেজি দাবাস খেজুর ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা, জিহাদি খেজুর ২৪০ টাকা, আজওয়া খেজুর ৯০০ টাকা, বরই খেজুর ৪০০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ৯০০ টাকা ও মেডজুল খেজুর ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে।
বিক্রেতারা বলছেন, আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে চাহিদা বাড়তে থাকায় দামও বাড়ছে খেজুরের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রাকিব জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা রাকিব জানান, দাম যা বাড়ার তা আগেই বেড়ে গেছে। মূলত রোজাকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে মিল মালিকরা। আর তার প্রভাবই এখন পড়ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে।
দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে মসলার বাজারেও। গত এক মাসের ব্যবধানে এলাচ-লবঙ্গের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। গোলমরিচ ও দারুচিনির দামও বাড়তি। এর কারণ জানেন না খোদ বিক্রেতারাও। তাদের দাবি, আমদানিকারকদের কারসাজিতেই বাড়ছে দাম।
নতুন করে ঝাঁজ লেগেছে পেঁয়াজের দামেও। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। আমদানিশুরু হলেও বাজারে দেখা নেই ভারতীয় পেঁয়াজের। উধাও পুরাতন দেশি পেঁয়াজও। দু-একটি দোকানে পাওয়া গেলেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে, তাই ফের দাম বাড়ছে। কেরানীগঞ্জের আগানগর বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা আসলাম বলেন, বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ কম আসছে। এ ছাড়া বাজারে অন্য জাতের পেঁয়াজ ও ভারতীয় পেঁয়াজও নেই। তাই দাম বাড়ছে।র তবে, সরবরাহ ঠিক থাকায় নতুন করে দাম বাড়েনি আদা ও রসুনের। কেবল মানভেদে দামে কিছুটা তারতম্য আছে।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে আলু ও মরিচ বাদে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের শাক-সবজির দাম। কেজিতে দাম বেড়েছে ৫-১৫ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি দাম বাড়ায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়ছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মুলা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, শালগম ৪০ টাকা, করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, লতি ৮০ টাকা, শিম ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, পেঁপে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ও গাজর বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
এ ছাড়া প্রতি কেজি বেগুন জাতভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা, ক্ষীরাই ৫০ টাকা, টমেটো ৬০ থেকে ৭০ টাকা, কহি ৮০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা ও পেঁয়াজের কলি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। আর প্রতি পিস লাউ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, আকারভেদে প্রতিপিস ফুলকপি ৩০ থেকে ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ও ব্রকলি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে বাজারে কমেছে নতুন আলু ও কাঁচামরিচের দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। আর পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। এদিকে, উভয় পর্যায়ে দাম কমে পাইকারিতে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায় ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। এ ছাড়া বাজারে লালশাকের আঁটি ১৫ টাকা, পুঁইশাক ২৫ টাকা, পালংশাক ১০ টাকা ও লাউ শাক ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যসব পণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবারও দাম বেড়েছে মাংস ও ডিমের। প্রতি কেজিতে মুরগির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতাদের দাবি, পাইকারি বাজারে মুরগির সরবরাহ কমে গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২১০ থেকে ২২০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩২০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৫০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩১০ টাকায়। আর জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকায়।
বাজারে আজ প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা গেছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। গত মাসে নিজেরাই গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা বেঁধে দিলেও এখন থেকে গরুর মাংসের দাম নির্ধারিত থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে মাংস ব্যবসায়ী সমিতি। প্রতিকেজি গরুর মাস ৬৫০ টাকায় বিক্রি করায় ব্যবসায়ীরা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন দাবি করে আপাতত ৭০০ টাকা দরে বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ৭০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রির কথা বললেও কেন ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জের আগানগর বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ৭৫০ টাকায় ভালো মানের মাংস বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করে পোষাচ্ছে না তাদের।
গত সপ্তাহের তুলনায় এখন ডজন প্রতি ৫ টাকা বেড়েছে ডিমের দাম। প্রতি ডজন লাল ডিম ১৪০ টাকা ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে আজ। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম ২৪০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ২৪৫ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে মাছের বাজারের অস্থিরতাও থামছে না। সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে দেশি মাছের দাম। হাতে গোনা কয়েকটি চাষের মাছের দাম কমলেও তা নাগালের বাইরে বলে দাবি ক্রেতাদের।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, আকারভেদে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতলা ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৬৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫৫০ টাকা, চাষের কৈ ২৫০ টাকা, কোরাল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও তেলাপিয়া ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রতি কেজি বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, বাইম ১ হাজার টাকা, দেশি কৈ ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। আর প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকার ওপরে।
কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হরিপদ বলেন, মাছের সরবরাহ না বাড়ায় দামও কমছে না।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, খাদ্য অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নামলেও সুখবর নেই চালের বাজারে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে দাম যতটা বেড়েছে, তার তুলনায় কমেছে সামান্য। খুচরা পর্যায়ে চালভেদে কেজিতে কেউ কেউ এক-দুই টাকা কম রাখলেও বেশিরভাগ বিক্রেতা আগের বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সির আল হাসিব বলেন, নতুন করে বাড়েনি চালের দাম। তবে মিল-মালিকদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আবারও বাড়তে পারে চালের দাম।
নিত্যপণ্যের এ অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা সাধারণের। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়। আর বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।