রোহিঙ্গা নারীরা যেখানে কর্মব্যস্ত, শিশুরা পড়ছে বর্মি ভাষায়

0
187
কুতুপালংয়ের এক ক্যাম্পে পাটের ব্যাগ তৈরিতে কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন রোহিঙ্গা নারীরা

এ সেন্টার যে খুব বড়, তা নয়। সব মিলে শ্রমিক আছেন ১৫০ জন। কাজ হয় দুই পালায়। প্রতি পালায় ৭৫ জন নারী কাজ করেন। ২০২০ সালের শুরুতে ছোট পরিসরে সেন্টারটির কার্যক্রম শুরু হয়। ৬০ রোহিঙ্গা নারীকে ৪০ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেন্টারের যাত্রা শুরু। করোনাভাইরাসে সংক্রমণের কারণে উৎপাদনে যেতে দেরি হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেন্টারটি উৎপাদনে যায়। ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় এটি বাস্তবায়ন করছে এনজিও ফোরাম।

রোহিঙ্গা শিবিরে ‘জুট ব্যাগ প্রোডাকশন সেন্টারে’ কাজ করছেন নারীরা

রোহিঙ্গা শিবিরে ‘জুট ব্যাগ প্রোডাকশন সেন্টারে’ কাজ করছেন নারীরা

শ্রমিকদের প্রতি ঘণ্টায় ৫০টাকা হারে মজুরি দেওয়া হয়। ক্যাম্পের ভেতরে এ কাজের জন্য একজন শ্রমিককে মাসিক সর্বোচ্চ আট হাজার টাকার বেশি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে প্রত্যেক শ্রমিক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পান। মূলত বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে থাকা নারীদের এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ করছিলেন রোহিঙ্গা নারী রেনোয়ারা। ছয় বছর আগে মিয়ানমারে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তিন সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন রেনোয়ারা। তিনি  বলেন, মিয়ানমারে থাকতে তিনি গৃহস্থালি কাজ করতেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর দুই বছরের বেশি সময় ধরে এ কারখানায় কাজ করছেন। এখানেই তাঁকে কাজ শেখানো হয়েছে। ঘণ্টায় ৫০ টাকা করে পান। এ টাকা তিনি বাচ্চাদের পড়ালেখা, ওষুধ, কাপড় কেনাসহ বিভিন্ন কাজে খরচ করেন। এটি তাঁকে সাহস জুগিয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তারা জানান, ক্যাম্প-২ ইস্ট, নয়াপাড়া, কুতুপালং ও ক্যাম্প-২৬–এ সব মিলিয়ে এ ধরনের ৬টি সেন্টার আছে। এর মধ্যে চারটি সেন্টারে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন, আন্ডারগার্মেন্ট তৈরি করা হয়, যা দিয়ে ১৬টি ক্যাম্পের চাহিদা পূরণ করা হয়। এখানে ১ হাজার ১৫০ কর্মী কাজ করেন। অবশ্য এ উদ্যোগ খুবই সীমিত। বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এখন মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৭ জন। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী।

রোহিঙ্গা শিবিরে শিখছে শিশু

রোহিঙ্গা শিবিরে শিখছে শিশু

ইউএনএইচসিআরের লাইভলিহুড অফিসার সুব্রত কুমার চক্রবর্তী  বলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন। তাঁদের উৎপাদন সক্ষমতা আছে। নতুন উদ্যোগও নেওয়া যায়। তবে ক্যাম্পের ভেতর চাহিদা থাকতে হয়। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তহবিল কমে আসছে, তাই সামনের দিনে হয়তো উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড আরও বাড়ানোর ইচ্ছা তাঁদের আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আলামত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে দাতাগোষ্ঠীর কাছেও এখন রোহিঙ্গা সংকট আর জরুরি পরিস্থিতি নয়। দিন দিন নতুন নতুন সংকট সামনে আসছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি—সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহ কমে আসছে। ইতিমধ্যে তাদের খাদ্যসহায়তা কমানো হয়েছে।

সামনে আরও সুযোগ-সুবিধা কমাতে হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জন্য আরও বড় আকারে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া গেলে তহবিলসংকট কিছুটা হলেও মোকাবিলা করা যাবে। তবে এ ধরনের উদ্যোগ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এ দেশের জনগণের সঙ্গে একত্রীকরণকে (ইন্টিগ্রেশন) উৎসাহী করবে কি না, তা নিয়েও আলোচনা আছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংকট আছে। মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসরণে সেখানে পড়ানো হয়

রোহিঙ্গা শিবিরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংকট আছে। মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসরণে সেখানে পড়ানো হয় 

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান বলেন, লাইফ স্কিলের জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং ফ্রেমওয়ার্ক করছে সরকার। কী ধরনের দক্ষতা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছে। কিছু প্রকল্প আশ্রয়শিবিরে চলছে। তরুণ জনগোষ্ঠীকে অলস রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যাম্পের ভেতরে যেসব কাজ, তাঁরা তা করতে পারেন, যেমন শিবিরগুলোতে কয়েক লাখ মানুষের চুল–দাড়ি কাটার জন্যও অনেক মানুষ দরকার।

শিশুরা পড়ছে বর্মি ভাষায়

অবশ্য বরাবরই বাংলাদেশ সরকার জোর দিচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ওপর। কখনো রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে গেলে যাতে বোঝা হয়ে থাকতে না হয়, এ কারণে তাঁদের বিভিন্ন জীবনমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার এ উদ্যোগ। এ চিন্তা থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করানোরও উদ্যোগ আছে আশ্রয়শিবিরগুলোতে। ২০১৮ সাল থেকে এখানে পড়ালেখা শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তেমনই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (লার্নিং সেন্টার) ‘স্কলার পার্ক-২’। এখানে গিয়ে কথা হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

শুরুতে বাংলা মাধ্যমে পড়ানো হলেও গত বছরের জুলাই থেকে এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো হচ্ছে মিয়ানমারের শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) অনুসরণ করে। ভাষাও মিয়ানমারের বর্মি ভাষা। সরকার ২০২০ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের শিক্ষাক্রম চালু করার অনুমোদন দেয়। কিন্তু করোনার কারণে এটি চালু করতে দেরি হয়। এখন প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে দুজন শিক্ষক থাকেন—একজন রোহিঙ্গা ও একজন বাংলাদেশি। বাংলাদেশি শিক্ষক মূলত ইংরেজি পড়ান।

স্কলার পার্ক-২ স্কুলের একজন শিক্ষক বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মো. রিয়াজ। তিনি মিয়ানমারে মেট্রিক পাস করেছিলেন। তিন মাস আগে তিনি এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি  বলেন, জীবন উন্নত করতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পড়ালেখা দরকার। রোহিঙ্গারা পড়ালেখার সুযোগ পেলে হয়তো কেউ চিকিৎসক হবেন, কেউ প্রকৌশলী হবেন। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, একদিন নিজ দেশে সবাই ফিরে যাবেন এবং সেখানে একটি ভালো জীবন পাবেন। এ কারণে শিশুদের পড়ালেখা করাটা খুব জরুরি।

শিবিরে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তরের। এখানে সাতটি বিষয় পড়ানো হয়। মাধ্যমিক স্তরেরও শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের মূলত ঘরেই (হোম বেজড) পড়ানো হয়। আগামী বছর একটি ব্যাচ দশম শ্রেণি শেষ করবে। দশম শ্রেণি পাস করার পর তাদের কে সনদ দেবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। এখনো এর কোনো সুরাহা হয়নি। এর বাইরেও আছে কিছু সংকট।

ইউএনএইচসিআরের এডুকেশন অ্যাসোসিয়েট হাসিনা আক্তার  বলেন, এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংকট আছে। আরেকটি সমস্যা হলো শিক্ষকসংকট। এখন মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসরণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষক হওয়ার মতো শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম।

এ কারণে শিক্ষকের সংকট হচ্ছে। তিনি জানান, আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট লার্নিং সেন্টার আছে ৫ হাজার ৮৯১টি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ হিসাবে মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬০৮ জন। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭০ জন মিয়ানমারের শিক্ষাক্রমের আওতায় এসেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.