রেকর্ড উৎপাদনেও আলুর রেকর্ড দাম

0
157

রাজধানীর তেজতুরিবাজার এলাকায় বিবিএর ছাত্র তারেক হাসানের মেসজীবন। গতকাল মঙ্গলবার কারওয়ান বাজার থেকে আলু কিনতে গিয়ে তাঁকে খেতে হয়েছে দামের ধাক্কা। ৪৫ টাকা দরে দুই কেজি আলু কিনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘খরচ ও সময় বাঁচাতে মেসে বেশির ভাগ সময় আলুভর্তা, ডিম আর ডাল রান্না হয়। এক মাস আগে যে আলু কিনেছি ৩২ টাকায়, আজ গুনতে হয়েছে ৪৫ টাকা। আলু তো আমদানি করতে হয় না। তাহলে দাম বাড়ছে কোন যুক্তিতে?’

হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে ৫০ টাকা দরে তিন কেজি আলু কিনেছেন আসিফ। গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ওয়ার্ডবয়ের চাকরি করেন তিনি। আসিফ বলেন, ‘১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। কম মাইনের কারণে বেশির ভাগ সময় আলু-ডিমই ভরসা। সম্প্রতি ডিমের দাম বাড়ার কারণে আলুভর্তা খাচ্ছি বেশি। তবে সেটিরও দাম বাড়ায় এখন নতুন দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’
দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ নিম্ন আয়ের মানুষও। নাখালপাড়া সমিতি বাজার থেকে ৪৮ টাকা দিয়ে এক কেজি আলু কিনেছেন গৃহিণী সাহানারা বেগম। তাঁর স্বামী রিকশাচালক। তিনি বলেন, ‘মাছে হাত দেওয়া যায় না। সব ধরনের সবজির দামও বেশি। সামনে আলু খাওয়াও কমাতে হবে।’

শুধু তারেক হাসান, আসিফ কিংবা সাহানারা বেগমই নন; আলুর দাম ভোগাচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে।

দেশে এবার রেকর্ড ভেঙেছে আলুর উৎপাদন। হিমাগারেও আছে ভরপুর মজুত। তবু বাজারে  রেকর্ড দরে বেচাকেনা হচ্ছে আলু। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় এক কেজি আলু কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সবজিজাতীয় এ পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। আর এক মাসে কেজিতে বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৬ টাকা। এ পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেশের হিমাগারে কত আলু মজুত আছে, সে তথ্য সংগ্রহে নেমেছে। কেন আলুর দাম এমন টালমাটাল? সমকাল এ তথ্য তালাশ করতে নেমে পেয়েছে ‘নানা মুণির নানা মত’!

আলুর দাম বাড়ানোর পেছনে মধ্যস্বত্বভোগী ও হিমাগারের মালিকদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, হিমাগারে মজুত আলু ও উৎপাদনের তথ্য যাচাই করলেই এক সপ্তাহের মধ্যে নাগালে চলে আসবে দাম। খোদ সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেও দাম বাড়ার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হয়েছে। যদিও হিমাগার মালিকদের দাবি, চড়া দামের পেছনে তারা নেই; দাম বাড়াচ্ছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। আর বিক্রেতারা বলছেন, আলু বেশি উৎপাদন হয় উত্তরাঞ্চলে। সেসব এলাকায় এখন দাম বাড়তি। এ কারণে ঢাকার বাজারে প্রভাব পড়েছে। তবে বাজারে আলুর সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বছরে আলুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টন। তবে এ মৌসুমে ফলন আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টন। পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ লাখ টন বেড়ে উৎপাদন দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টনে। সেই হিসাবে চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২২ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে।

এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবার ৩৬৫ হিমাগারে প্রায় ২৫ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এখনও প্রায় ২২ লাখ টন আলু মজুত রয়েছে। যদিও হিমাগার মালিকরা বলছেন, মে মাস থেকেই হিমাগারের আলু সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত নেই।

উৎপাদন খরচের পাঁচ গুণ দাম খুচরায়

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজির দাম হতে পারে ১৫ টাকার মতো, যা খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা হতে পারে। অথচ হিমাগার থেকে এখন আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকায়, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। মাসখানেক আগে ঢাকার খুচরা বাজারে আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা ছিল। তবে সোম ও মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, সেগুনবাগিচা, মালিবাগ ও হাতিরপুল কাঁচাবাজারে আলুর কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে। পাড়া-মহল্লায় বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে। এই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৯ থেকে ১৬ টাকা।
সাধারণ মানের এসব আলুর পাশাপাশি কিছু এলাকার সুস্বাদু আলুও পাওয়া যায় বড় বাজারগুলোতে, যেগুলোর দাম দ্বিগুণের বেশি। বগুড়ার লাল আলুর কেজি ৬০ ও ময়মনসিংহ এলাকার ছোট গোল আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। ১৫ থেকে ২০ দিন আগে এ দুই এলাকার আলুর কেজি বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৪৫ থেকে ৫০ এবং ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনন্দিন বাজার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশের বেশি।

কারসাজিতে কারা?

পাইকার ও আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলু কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি বাজারে আসে না। মাঠ থেকে তোলার পর সিংহভাগ চলে যায় হিমাগার ও মজুতদারের কাছে। তাদের হাত ধরে তা বাজারে আসে। মাঝখানে বড় একটা সময় থাকে হিমাগারে। প্রায় বছরজুড়ে সংরক্ষণের সময়টাতে ব্যবসায়ীরাই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। অনেক হিমাগার মালিকও আবার আলুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মূলত তারাই হিমাগারে আলু রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ান।

গত জুলাইয়ে খোদ সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেও আলুর বাজারের কারসাজির চিত্র উঠে আসে। সংস্থাটির প্রস্তুত করা ‘বাংলাদেশে আলুর সাপ্লাই চেইন ও মূল্যবৃদ্ধি’ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, হিমাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী আলু খালাস হচ্ছে না। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অপকৌশল করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দাম বাড়ানোর মূল কারিগর হিমাগারের মালিক ও মজুতদাররা। তবে দাম বাড়ার ফলে ভোক্তার খরচ বাড়লেও এর সুফল কৃষক পাচ্ছেন না। কৃষিপণ্যের প্রকৃত উৎপাদন খরচ হিসাব করতে কৃষি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা প্রতিনিধি নিয়ে তদন্ত করা উচিত। একই সঙ্গে আড়ত, হিমাগার পর্যায়ে কী হচ্ছে– তাও খতিয়ে দেখা দরকার। এ পদক্ষেপ নিলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য।

এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উৎপাদন একটু বেশি হলে চাষিরা আলু বিক্রি করতে পারেন না। অনেক সময় ইচ্ছা করলেও আলুর দাম বাড়ানো যায় না। এবার উৎপাদন বেশি। তার পরও আলুর দাম বেশি কেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে উদ্যোগ নিতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হিমাগার মালিকদের দ্বিমত

সরকার আলুর ফলনের রেকর্ড তথ্য দিলেও কোল্ডস্টোরেজের মালিকদের দাবি, সরকারের তথ্য ঠিক নয়। এ বছর অন্তত ২০ লাখ টন আলু উৎপাদন কম হয়েছে। হিমাগার ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত বছরের চেয়ে এবার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আলু কম এসেছে হিমাগারে। ফলে মে মাস থেকেই হিমাগার থেকে বাজারে আলু সরবরাহ করা হচ্ছে।
হিমাগার ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগারের আলুর মাত্র ১০ শতাংশ হিমাগার মালিকদের, ৫০ শতাংশ মজুতদার ব্যবসায়ীর আর বাকি ৪০ শতাংশ কৃষকের। এর মধ্যে কৃষকরা ২০ শতাংশ আলু রাখেন বীজের জন্য। বাকি ২০ শতাংশ বাজারে বিক্রি করে দেন। সব মিলিয়ে হিমাগারে সংরক্ষিত ৮০ শতাংশ আলু খাওয়ায় ব্যবহার হয়। চিপস ও অন্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য কিছু আলু সংরক্ষিত রাখে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। রপ্তানি করার জন্যও ভালো মানের কিছু আলু থাকে হিমাগারে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, উৎপাদন খরচ, হিমাগার ভাড়াসহ প্রতি কেজি আলুতে খরচ হয় ১৮ থেকে ২০ টাকা। তবে হিমাগারেই এখন আলুর কেজি ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা। এর সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা, পরিবহন ও অন্য খরচ যোগ হয়ে খুচরা পর্যায়ে যেতে যেতে ৫০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এটা অস্বাভাবিক।

এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ আলু মজুত আছে, তা কৃষি বিভাগ থেকে সংগ্রহ করে দিলে ভোক্তা অধিদপ্তরের বাজার তদারকি সহজ হবে। তবে গতকাল থেকে সারাদেশের হিমাগারে মজুত আলুর তথ্য সংগ্রহে কাজ শুরু হয়েছে।

বগুড়ায় আলু আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট

বগুড়া ব্যুরো থেকে এস এম কাউসার জানান, বগুড়ায় গত বছরের এ সময়ে খুচরায় আলুর কেজি ছিল ১২ টাকা, যা এখন তিন গুণের বেশি বেড়েছে। দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জড়িত বলে খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। হিমাগারে রাখা আলু চাহিদা অনুযায়ী বের না করে সংকট তৈরির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়েছে।
হিমাগার মালিকরা বলছেন, বগুড়া-জয়পুরহাটের ৬২ হিমাগারে মজুত করা হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার ২৪৭ টন আলু। বগুড়া জেলা কৃষি বিপণন বিভাগের তথ্য বলছে, জুনে চাহিদার বিপরীতে হিমাগার থেকে আলু বের করা হয়েছে ৬৮ হাজার ৬০৪ টন। জুলাইয়ে বের করা হয় মাত্র ২৪ হাজার ১২৪ টন। অথচ বাজারে জুলাইয়ে চাহিদা ছিল গড়ে ৬৫ হাজার টনের। ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে হিমাগার থেকে আলু বের না করায় সেই থেকে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়।

জেলা হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শাহ সুলতান কোল্ডস্টোরেজের মালিক আবদুল গফুর বলেন, দাম কমে যাওয়ায় গেল কয়েক বছর হিমাগারে আলু রেখে লোকসান দিয়েছেন মজুতদাররা। এবার দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা বেশ লাভবান হয়েছেন। তবে আলুর কোনো সিন্ডিকেট নেই। শাকসবজির দাম বাড়ায় আলুর দামও বেড়েছে।
কৃষি বিপণন বিভাগের মাঠ ও বাজার পরিদর্শক আবু তাহের বলেন, কী কারণে আলুর দাম বেড়েছে, তা আলু ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা ভালো জানেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পলাশ কুমার সরকার জানান, বেশির ভাগ কৃষক আলু উৎপাদনের পরই বিক্রি করে দেন। বড় ব্যবসায়ীরা তা কিনে হিমাগারে মজুত করেন। এখন কৃষকের ঘরে আলুর মজুত নেই। হিমাগার থেকে সীমিত আকারে সরবরাহ করা হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.