- পাঁচ দেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য এসেছে। তিন দেশের আংশিক বাকি।
- সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে ফিলিপাইনে।
এঁদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন এক শীর্ষ কর্মকর্তা, একজন নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), একজন মহাব্যবস্থাপক (জিএম—বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর), চারজন যুগ্ম পরিচালক (এঁদের দুজন বর্তমানে উপমহাব্যবস্থাপক), তিনজন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম—দুজন বর্তমানে জিএম) ও তিনজন উপপরিচালক।
ওই কর্মকর্তারা মূলত রিজার্ভ চুরির সুযোগ করে দিয়েছেন। এঁদের কেউ সার্ভার কক্ষ খোলা রেখে, কেউ ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে, কেউবা অনুপস্থিত থেকে হ্যাকারদের সুযোগ করে দিয়েছেন। এসব কর্মকর্তা তখন ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং, আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ এবং ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের কর্মকর্তা ছিলেন।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের একটি শাখায় চারটি হিসাবে যায়। পরে বিভিন্ন সময় ফেরত আসে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এখনো উদ্ধার করা যায়নি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা (১০৫ টাকা দরে) ৬৯৩ কোটি টাকা। ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়।
সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) ব্যবহার করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফট বার্তার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আটজন। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের (এবিডি) আওতাধীন একটি কক্ষে (ব্যাক-অফিস) এই বার্তা বিনিময় হয়। এই আট কর্মকর্তার একজন ছিলেন তৎকালীন সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজউদ্দিন। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি ১৮টি বার্তার মাধ্যমে নিউইয়র্ক ফেডকে ৩১ কোটি ৯৭ লাখ ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার স্থানান্তরের বার্তা পাঠান। পরে অফিস ত্যাগের আগে তিনি সুইফট থেকে লগআউট করেন।
রিয়াজউদ্দিন অফিস ত্যাগের পর তাঁরই ব্যবহার করা নাম (ইউজার আইডি) ও গোপন সংকেত (পাসওয়ার্ড) দিয়ে রাতে নিউইয়র্ক ফেডকে ৩৫টি বার্তা পাঠিয়ে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার ৮৮৬ ডলার স্থানান্তরের আদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে চারটি হিসাবে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে ২ কোটি ডলার স্থানান্তরের অনুরোধ যায়।
ইংরেজি ‘ফাউন্ডেশন’ বানানে ভুলের কারণে শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে পাঠানো অর্থ আটকে যায়। ৩৫টি বার্তার মধ্যে চারটি কার্যকর হয়। সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি টের পেয়ে নিউইয়র্ক ফেড বাংলাদেশকে ফিরতি বার্তা পাঠায়। সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এই ফিরতি বার্তা বাংলাদেশ জানতে পারে দুই দিন পরে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, রিজার্ভের অর্থ চুরির জন্য পুরোপুরি দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা। রিজার্ভ চুরির বিষয়টি জানার পরও তিনি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেননি। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ৩৮ দিন ওই ঘটনা গোপন রাখেন। এতে মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যায়। তাঁর এই কর্মকাণ্ডের কারণে হ্যাকাররা সহজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার নিয়ে যায়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনার অগ্রগতি সম্পর্কে গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, নিউইয়র্কের আদালতে মামলার বিচারকাজ শিগগিরই শুরু হবে। ফিলিপাইনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল সে দেশে গেছে। এসব মামলার রায় হলে চুরির টাকা ফেরত আসবে।
মেজবাউল হক বলেন, সিআইডির মামলার অগ্রগতির সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি
পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার অজ্ঞাতে কেউ আপনার ইউজার আইডি ব্যবহার করলে কি আপনি দায়ী হবেন?’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও হংকংয়ের নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তারা পেয়েছেন। তবে চীন, জাপান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আংশিক তথ্য পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেলে সরকারের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মামলার তদন্তের স্বার্থে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় যান সিআইডির কর্মকর্তারা। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে ফিলিপাইনের মায়া সান্তোস ও শ্রীলঙ্কার দুজন চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেন।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, সিআইডির মামলার তদন্ত শেষ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খানসহ পুলিশ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তা গত ২৮ জানুয়ারি ফিলিপাইনের আদালতে মামলার সাক্ষ্য দিতে সেখানে গেছেন। ওই মামলার রায় হলে রিজার্ভ চুরি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।