গুলিবিদ্ধ তরুণ সাহাদত হোসেনকে (শ্যামল) ক্ষতিপূরণ দিতে চাচ্ছে না পুলিশ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুলিশকে ওই ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল; কিন্তু পুলিশ বলছে, ‘বিধিমোতাবেক’ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য সরকারি কোষাগারে গুলির খরচ ১৫০ টাকা জমা দিয়েছেন। অভিযুক্তকে দুই ঘণ্টা করে পাঁচ দিন পিটিও করতে হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক শুনানিতে সাহাদত হোসেনকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি এসেছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের অসতর্কতায় গুলি খেয়ে একজন মানুষের চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করার বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এর দায়ভার কোনোক্রমেই রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। কমিশন সাময়িক ক্ষতিপূরণ হিসেবে সাহাদতকে দুই লাখ টাকা দিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে।
৩১ মে মানবাধিকার কমিশনের ওই শুনানিতে অংশ নেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব শফিকুল ইসলাম এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিরুল ইসলাম।
এর আগে মানবাধিকার কমিশন গুলিবিদ্ধ সাহাদত হোসেনকে ক্ষতিপূরণ ও দায়ী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় মামলা দায়েরের পর কমিশনকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। শুনানিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ক্ষতিপূরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য বললেও কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের ছেলে সাহাদত হোসেন পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ। ঘটনাস্থল ছিল মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার কামারকান্দা পুলিশ বক্সের সামনে। সাহাদতের বয়স এখন ২৪ বছর। কেরানীগঞ্জে তাঁর ভাইয়ের ফ্রিজ মেরামতের দোকান রয়েছে। সেখানে তিনি কাজ করেন।
১৪ জুন ভুক্তভোগী সাহাদতের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের বাসায় কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, তাঁরা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে তিনটি মোটরসাইকেলে মুন্সিগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। পুলিশের সংকেত পেয়ে তিনি ও তাঁর অপর এক বন্ধু মোটরসাইকেল থামান। তারপরও পুলিশ পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। গুলি করার পরদিন সাহাদত ও তাঁর পাঁচ বন্ধুর নামে পুলিশ মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানায় মামলা করে। ঘাটারচর থেকে চার বছর ধরে ওই মামলায় মুন্সিগঞ্জ গিয়ে আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন সাহাদত।
গুলিবিদ্ধ সাহাদত ও তাঁর বন্ধুদের বিরুদ্ধে পুলিশ বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, পুলিশের সংকেত না মানা, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং মাঝারি ও গুরুতর আহত করার অভিযোগ আনে। মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, যে চারটি ধারায় সাহাদত ও তাঁর বন্ধুদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর জেল ও আর্থিক জরিমানা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার পরপরই দৈনিক আমাদের সময় ‘পায়ে গুলি করে পুলিশের দুঃখপ্রকাশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিষয়টি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নজরে আনলে কমিশন তদন্ত দল গঠন করেছিল। এরপর চার বছর ধরে কমিশন বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে আসছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০০৯ সালে গঠিত সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এর আগে কমিশন র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনকে নিয়েও ছোটাছুটি করেছিল। চিরতরে পঙ্গু লিমন এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি। বিচার চেয়ে লিমনের মায়ের করা মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি। কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২) অনুযায়ী, গত বছর কমিশনের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ জমা পড়ে।
কমিশনের নির্দেশনা আমরা প্রতিপালন করে থাকি।’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা দুটি জিনিস চেয়েছি। দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং যে মানুষটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তার ক্ষতিপূরণ। কমিশনের কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে পুলিশ। আমরা জানিয়ে দিয়েছি, এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।’
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘কমিশনের নির্দেশনা আমরা প্রতিপালন করে থাকি।’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
পুলিশের যত ওজর-আপত্তি
পুলিশের দাবি, সাহাদত পুলিশের কনস্টেবল সাইফুল ইসলামের হাত থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। সাহাদত ও তাঁর বন্ধুরা সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন এবং সামান্য ও গুরুতর জখম করেছেন মো. রাসেল নামের এক পুলিশ সদস্যকে। কনস্টেবল সাইফুল অসতর্ক থাকায় ধস্তাধস্তিতে গুলি বেরিয়ে গেছে। তাঁর দায়িত্বে অবহেলা ছিল।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে পুলিশ সে রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। তারা বলেছে, ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ রাত ৯টা ১০ মিনিটে পুলিশ সদস্য মো. শহিদুল ইসলাম, মো. রাসেল, মেহেদী হাসান ও মো. সাইফুল ইসলাম তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ পাঁচটি মোটরসাইকেল বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে আসতে দেখে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. শহিদুল ইসলাম তাঁদের থামতে বলেন।
প্রতিবেদনে পুলিশ আরও জানায়, সংকেত দিলে মোটরসাইকেলের আরোহী সজীব মণ্ডলসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ওপর চড়াও হন। তাঁরা পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে নেওয়ার হুমকিসহ ‘আজেবাজে’ কথা বলেন এবং মারধর করেন। একপর্যায়ে সাহাদত কনস্টেবল সাইফুল ইসলামের পিস্তল ছিনিয়ে নিতে যান। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পিস্তল থেকে একটি গুলি বেরিয়ে সাহাদতের পায়ে লাগে। এ ঘটনার পরও রাস্তার পাশে থাকা গাছের ডাল দিয়ে সাহাদতের বন্ধুরা তাঁদের এলোপাতাড়ি পেটান।
ওই ঘটনার পরদিন পুলিশ সাহাদতসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাও করে। মাস তিনেকের মধ্যে তদন্ত শেষ করে পুলিশ ২৬ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন।
পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি মনে করে, পুলিশ সদস্য সাইফুল অসতর্ক ছিলেন। ঘটনাটি তাঁর দায়িত্বে অবহেলা ও অদক্ষতার দৃষ্টান্ত। বিধিমোতাবেক একটি রবার কার্তুজের দাম ১৫০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। অদক্ষতার জন্য সাইফুলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি সপ্তাহে পাঁচ দিন দুই ঘণ্টা করে পিটি করেছেন।
দোষ ঢাকতে চায় পুলিশ, অভিযোগ সাহাদতের
সাহাদত বলেন, সেই রাতে পুলিশকে তিনি যে প্রশ্ন করেছিলেন, এখনো তাঁর সেই একই প্রশ্ন। তাঁর অপরাধটা কী? সাহাদতের অভিযোগ নিজেদের দোষ ঢাকতে পুলিশ ইচ্ছেমতো মামলা সাজিয়েছে।
সাহাদত মনে করেন, পুলিশের দায়ের করা মামলায় সাত সাক্ষীর মধ্যে স্বতন্ত্র সাক্ষী মঙ্গল আলী আদালতে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতেই প্রমাণিত হয়, পুলিশ মিথ্যা বলেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গল আলী মুন্সিগঞ্জ অ্যাডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘গুলির আওয়াজ পেয়ে আমরা উঠলাম। গেট খুলে দেখি, পুলিশ বক্সটার কাছে অনেক মানুষ। …পুলিশ বলল যে, হোন্ডা থামানোর জন্য আগে সিগন্যাল দিলে আরোহীরা সিগন্যাল না মানায় পুলিশের বন্দুক থেকে একটা গুলি ছুটে গেছে। …শুনলাম, ওই আসামিরা অনুষ্ঠান থেকে আসতেছিল। পুলিশ থামতে বলায় তারা থেমেছে।’
সাহাদত বলেন, পুলিশ প্রথমে মামলা করতে চায়নি। গুলি করার পর তাঁরা তাঁর বন্ধুদের ডেকে বলেন, ‘একে (সাহাদত) নিয়ে যা। না হলে বিপদ হবে।’ সাহাদতের বন্ধুরা তখন বলেছিলেন, গুলির আঘাত দেখলে কোনো হাসপাতাল ভর্তি করবে না। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর পুলিশ প্রথমে সাহাদতকে সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ তিনিসহ তাঁর বন্ধু সজীব মণ্ডল, শ্রীকৃষ্ণ বাড়ৈ, গোবিন্দ সিদ্ধা, জনি সিদ্ধা ও মো. রাকিবের বিরুদ্ধে মামলা করে।
পুলিশ আমার ডান পায়ে পিস্তল ঠ্যাকায়া গুলি করছে। তিন মাস চিকিৎসা নিছি। কিন্তু পা পুরা ঠিক হয় নাই। ফ্রিজ সারাইয়ের কাজ করতাম। ঠিকমতো উঠতে-বসতে পারি না। জোর কইরা যেদিন কাজ করি, ওই দিন রাইতে ব্যথায় ঘুমাইতে পারি না
সাহাদত ও তাঁর স্বজনদের দাবি, পুলিশ তাঁদের বিভ্রান্ত করেছে। ঘটনার পরপরই তাঁরা মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তখন তাঁদের জানায়, দুই-তিন দিন হাজিরার পরই মামলা খারিজ হয়ে যাবে। পুলিশ সব সময় সাহাদতের পাশে থাকবে, সব ধরনের সহযোগিতা করবে। পরিবারও সে সময় পুলিশের প্রস্তাব মেনে নেয়। তারা চিকিৎসার জন্য তিন হাজার টাকাও সে সময় দিয়েছিল।
তবে জামিনের আগে দুই মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের দেখা পেলেও পরে আর পুলিশ যোগাযোগ করেনি। আদালত থেকে জামিন নেওয়ার পর সাহাদতকে আরও এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। পায়ের পাতার যেখানে গুলি লেগেছিল, সেখানে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করেন। ঘা শুকাচ্ছিল না, ব্যথার সঙ্গে সারাক্ষণ পুঁজ পড়ছিল। ধারদেনা করে বাকি চিকিৎসা তিনি নিজেই করেন।
সাহাদত বলেন, ‘পুলিশ আমার ডান পায়ে পিস্তল ঠ্যাকায়া গুলি করছে। তিন মাস চিকিৎসা নিছি। কিন্তু পা পুরা ঠিক হয় নাই। ফ্রিজ সারাইয়ের কাজ করতাম। ঠিকমতো উঠতে-বসতে পারি না। জোর কইরা যেদিন কাজ করি, ওই দিন রাইতে ব্যথায় ঘুমাইতে পারি না।’ সাহাদত বিছানায় বসে কথা বলেন, পাশেই দেয়ালে ঠেস দেওয়া ছিল তাঁর ক্রাচটি।
এক প্রশ্নের জবাবে সাহাদত আরও বলেন, প্রতি মাসে তিনি আদালতে হাজির হন। প্রতি হাজিরায় উকিলের ফি ও যাতায়াত বাবদ তাঁর কমপক্ষে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। গুলি করার পর পুলিশ চিকিৎসা খরচ দেওয়া ও মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কোনোটাই করেনি।
গুলির খরচ কোষাগারে জমা দেওয়া ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে পাঁচ দিন পিটি করিয়ে ক্ষতিপূরণ থেকে অব্যাহতি চাওয়ার প্রস্তাবকে মানবাধিকারকর্মী নূর খান হাস্যকর ও অমর্যাদাকর বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার বিচার করতে ব্যর্থ হওয়ায় গুলির এমন ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশের ওপর নির্দেশনা জারি করেছে। সেটি পুনর্বিবেচনার আবেদন অগ্রহণযোগ্য।