এ সময় আন্দ্রে রোদেনকো বলেন, রুশ জাহাজকে নিয়ে বাংলাদেশের পদক্ষেপের দরুন দুই দেশের ঐতিহাসিক সহযোগিতায় বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা আছে। পুরো বিষয়টি রাশিয়াকে চিন্তায় ফেলেছে। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি ঢাকায় জানানোর কথা বলেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব নিয়ে রাশিয়ার অবস্থান বিশ্লেষণ করলে এটা বোঝা যায়, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের রেশ এখানে স্পষ্ট। বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে জাহাজটিকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। কারণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজকে অনুমতি দিলে বাংলাদেশেরও শাস্তির মুখে পড়ার ঝুঁকি আছে। অথচ রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল একাধিকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জাহাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছে।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক হাত নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে রাশিয়া কি সুর বদলাল? সাধারণত অন্য দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এসব বিষয়ে রাশিয়াকে উচ্চকিত হতে দেখা যায় না। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাশিয়াকে অন্য রূপে দেখা গেল। বিশেষ করে ২০ ডিসেম্বরের পর থেকে অন্তত তিনবার ঢাকা এবং মস্কো থেকে বিবৃতি, টুইট ও নিয়মিত ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করে রাশিয়া। শুরুতে মনে হয়েছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দুই পরাশক্তির শীতল যুদ্ধের রেশ এখন ঢাকায় গড়াল।
তবে রাশিয়া কোন সময়ে এবং কেন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হয়। রাশিয়া গত বছরের ২০ ডিসেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের শাহীনবাগে বিএনপির এক নিখোঁজ নেতার বাড়িতে যাওয়ার সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছিল। ওই বিবৃতিতে শাহীনবাগের ঘটনার উল্লেখ না থাকলেও ২২ ডিসেম্বর মস্কোতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছিলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রাশিয়ার ২০ ডিসেম্বর বিকেলে বিবৃতি দেওয়ার সময় উরসা মেজর ভারতের কোচিন বন্দরে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশের পথে রওনা হয়েছিল। একই দিন, অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর সকালে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস কূটনৈতিক পত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায় যে উরসা মেজর নামের ওই জাহাজ আসলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা স্পার্টা ৩। জাহাজটির রং ও নাম পরিবর্তন করা হলেও এর আইএমও (আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা) সনদ নম্বর ৯৫৩৮৮৯২, যা প্রকৃত পক্ষে ‘স্পার্টা ৩’-এর আইএমও সনদ নম্বর। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ওই জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো, জ্বালানি সরবরাহ, জাহাজের নাবিকদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হলে ওই দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া বা বড় আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
২০ ও ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় রুশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুটি চিঠি পাঠায়। দুই চিঠিতেই রাশিয়া পণ্যবাহী ওই জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুরোধ জানায়। রাশিয়ার দেওয়া ২২ ডিসেম্বরের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, জাহাজটিকে প্রবেশের অনুমতি না দিলে সেটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ওই দিন বিকেলে ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মো. খুরশেদ আলমের দপ্তরে ডাকা হয়। এ সময় রুশ রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়, বাংলাদেশ ওই জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে দেবে না।
পরে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ঢাকায় সরকারের নানা পর্যায়ে আলোচনা করেই উরসা মেজরের অনুমতি আদায়ে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই জাহাজ ভারতের হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশে তা পাঠিয়ে দেবে।
রাশিয়ার জাহাজটি বাংলাদেশে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছিল। এমন এক পর্বে গত জানুয়ারি মাসে ভারত হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ওই সময় জ্যেষ্ঠ ওই মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে গেছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের জলসীমায়ও প্রবেশ করতে পারবে না ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ উরসা মেজর। গত ডিসেম্বরে সেটি ভারতের কোচিন বন্দরে পণ্য খালাস করলেও এবার সেটিকে হলদিয়া বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপের পর যে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরের সময় বলে গেছেন।
ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ ছাড়ার কাছাকাছি সময় উরসা মেজরও ভারতের জলসীমার কাছাকাছি থেকে সরে বঙ্গোপসাগর থেকে আরও সরে যায়। ডোনাল্ড লু ১৫ জানুয়ারি রাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছিলেন।
ভারত সাধারণত জাতিসংঘ ছাড়া কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত মেনে চলে না। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা বেশ কিছু রুশ জাহাজ ভারতে পণ্য খালাস করেছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে এবার উরসা মেজরের ক্ষেত্রে। ফলে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে কেন্দ্রে এনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিবৃতি, টুইট, ব্রিফিং তার সবকিছুর নেপথ্যে কাজ করেছে ভূরাজনীতি। উরসা মেজরকে বাংলাদেশ আর ভারতে ভিড়তে না দিয়ে আপাতত জয়টা যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে। তবে এর জেরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিরূপ প্রভাবের হুমকি রাশিয়া দিয়েছে, তার ফলটা কী হয়, সেটা সময় বলে দেবে।