ভ্লাদিমির পুতিন নিজেকে জার পিটার দ্য গ্রেটের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে গেলে বোঝা যায় তিনি পিটার দ্য গ্রেটের মতো রাশিয়ার প্রভাব বাড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো রাশিয়ার প্রভাব কতটা সংকুচিত করে ফেলেছেন।
পোল্যান্ড, ইউক্রেন এবং বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার মধ্য দিয়ে সড়কপথে ভ্রমণ করার সময় আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে, এসব দেশের প্রায় সবাইকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্র করার কাজটি পুতিনই করেছেন। এমনকি রুশ ভাষাভাষী যঁারা একসময় প্রায়ই মস্কোর প্রতি আনুগত্য অনুভব করতেন, তঁারাও এখন ইউক্রেনের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহ করছেন।
আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলোর একটি হলো ১৯৬০–এর দশকে আমি আমার দাদা–দাদির সঙ্গে দেখা করতে পোল্যান্ড গিয়েছিলাম (আমার ‘ক্রিস্টোফ’ নামটি আসলে ‘ক্রিস্তোফোভিচ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ)। আমার যদ্দুর মনে পড়ছে, ওই সময় কমিউনিস্ট পোল্যান্ডকে ভীষণ রকম অনালোকিত ও হতাশাচ্ছন্ন মনে হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে আমি যখন আইনের ছাত্র ও উদীয়মান সাংবাদিক হিসেবে পূর্ব ইউরোপে ভ্রমণ করা শুরু করি, তখন আমার মনে হচ্ছিল এই কমিউনিস্ট ব্লকে আপনার রঙিন ফিল্মের দরকারই নেই। এখানে এমনিতেই সব রঙিন।
ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেটিক সিনেটর ডিক ডারবিন ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভিলনিয়াসে (লিথুয়ানিয়ার রাজধানী) এসেছিলেন। তিনি আমাকে বলছিলেন, তিনি যখন ১৯৭৯ সালে প্রথম দেশটিতে এসেছিলেন, তখন দেশটির বিবর্ণ দশা দেখে তাঁর সেই কবিতার লাইন মনে পড়ছিল: ‘সবকিছু যেন ধূসর রঙে চুনকাম করা।
চারপাশ ছিল নিষ্প্রাণ-প্রাণহীন।’ সেই দৃশ্যকে পেছনে ফেলে এসে আজকের সেই একই দেশগুলোর দৃশ্য ডিক ডারবিনের অচেনা ঠেকছিল। সেই দেশগুলো এখন অনেক প্রাণবন্ত, রঙিন এবং রাশিয়ার চেয়ে অনেক ধনী। পোল্যান্ড ইউরোপের জন্য একটি অত্যাধুনিক শিল্প এলাকা হয়ে উঠেছে এবং বিশ্বখ্যাত কোম্পানি ইন্টেল ঘোষণা করেছে, তারা রক্লোর কাছে ৪৬০ কোটি ডলারের চিপ প্ল্যান্ট তৈরি করবে।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে বসবাস করা রুশ ভাষাভাষীদের (যাঁদের পরিবার সোভিয়েত শাসনামলে রাশিয়া ছেড়ে চলে এসেছিলেন) অধিকারের পক্ষে থাকা অগ্রগামী নেতা হিসেবে পুতিন নিজেকে দাবি করেন। ঐতিহাসিক কারণে এই রুশ ভাষাভাষীদের অনেকেই মস্কোকে সমর্থন করতেন এবং কমিউনিস্ট-উত্তর পশ্চিমাপন্থী সরকারগুলোর বিষয়ে আফসোস করতেন। পুতিন সেই রুশভাষী বিদেশিদের সহমর্মিতার অবসান ঘটিয়েছেন। ইউক্রেনে পুতিনের অভিযান সেই বিদেশি রুশ ভাষাভাষীদের বিব্রত করছে এবং মস্কোকে আর সমর্থন করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে তঁাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেনের লাভিভ এলাকার বাসিন্দা ওলেকসান্দ্রা কাবানোভা আমাকে বলছিলেন, তিনি এবং তাঁর স্বামীর আদি বাড়ি রাশিয়ায়। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলতেন, তখন রুশ ভাষাতেই বলতেন। কিন্তু তাঁর স্বামী গত বছর রাশিয়ার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইউক্রেনীয় বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকে নিজেদের মধ্যে আর রুশ ভাষায় কথা বলেন না। তাঁরা এখন ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলেন, যদিও সে ভাষায় তাঁরা সাবলীল নন।
বাল্টিক অঞ্চলের প্রতিটি দেশে এমন কিছু সংখ্যালঘু রুশভাষী ছিলেন, যাঁরা রাশিয়ার অন্ধ সমর্থক ছিলেন। তাঁরা এখন পুতিনবিরোধী হয়ে উঠছেন। পুতিন ন্যাটোকে ফের চাঙা করার কাজটিও করেছেন। ন্যাটো ইতিমধ্যে ফিনল্যান্ডকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সুইডেনকেও সদস্য করে নেওয়ার পথে আছে। এ ছাড়া ন্যাটোর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ন্যাটোভুক্ত কোনো রাষ্ট্রে রাশিয়া অভিযান চালালে ন্যাটোর সব কটি দেশ একযোগে হামলা চালাতে বাধ্য থাকবে।
এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাজা কালাস আমাকে বলেছেন, ‘এখানকার বেশির ভাগ রুশ ভাষাভাষী আমাদের পক্ষে। তারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে, রাশিয়ার জীবনের চেয়ে এখানকার জীবন অনেক বেশি ভালো।’ কঙ্কালের মতো চেহারার দানব ও পুতিনের চেহারা মিলিয়ে বানানো ছবির বিশাল বিশাল পোস্টার লাটভিয়ার রিগায় টাঙানো হয়েছে। এই পোস্টার দেখে সেখানকার লোকের পুতিন সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায়।
মৌলিক সত্য হলো পুতিন রাশিয়াকে সবদিক থেকে কাবু করে ফেলেছেন। রাশিয়া এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে ও জনসংখ্যাগতভাবে নিচের দিকে যাচ্ছিল। পুতিন সেই ধারাকে ত্বরান্বিত করেছেন। তঁার থাকার মধ্যে আছে পরমাণু অস্ত্র। এ অবস্থায় কেউ কেউ রাশিয়াকে ‘পরমাণু অস্ত্রধারী বুরকিনা ফাসো’ বলে ব্যঙ্গ করছেন।
একসময় মস্কো যে দেশগুলোকে শাসন করত, সে দেশগুলো এখন মস্কোর বিরুদ্ধে এক হয়েছে। এই দেশগুলো ভ্রমণ করার সুবাদে আমি এখন বাজি ধরে বলতে পারি, পুতিনকে আধুনিক যুগের পিটার দ্য গ্রেট হিসেবে স্মরণ করা হবে না। বরং উল্টোটা হতে পারে। নিজের দেশকে ভেঙে ফেলার কারণে তিনি ইতিহাসের তলায় ডুবে যেতে পারেন। তাঁকে ‘ভ্লাদিমির দ্য লিলিপুটিয়ান’ নামে চিহ্নিত করা হতে পারে।
- নিকোলাস ক্রিস্টোফ পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও নিউইয়র্ক টাইমস–এর নিয়মিত কলাম লেখক