রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিচুক্তি: দনবাস কীভাবে আলোচনার কেন্দ্রে এল

0
11
রাশিয়ার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি স্থাপনার পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। দনবাস, ইউক্রেন, ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সময় ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের একটি মূল শর্ত তুলে ধরেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেটি ছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দেশটির শিল্পাঞ্চল দনবাসের পুরো নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে।

ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল নিয়ে দনবাস গঠিত। শুক্রবারের বৈঠকের বিষয়ে জানাশোনা এমন একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই দুই অঞ্চল থেকে ইউক্রেনের সেনাসদস্যদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। বিনিময়ে ইউক্রেনের অন্য অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ করবেন তিনি।

তবে রাশিয়ার কাছে নিজেদের কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি বরাবরই নাকচ করে এসেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেনের জনগণেরও এ নিয়ে আপত্তি আছে। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির জরিপ অনুযায়ী, ইউক্রেনের ৭৫ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার হাতে নিজেদের ভূখণ্ড তুলে দেওয়ার বিপক্ষে।

২০১৪ সাল থেকে দনবাসে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন পুতিন। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছিল মস্কো। ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে গোপনে সেনাও পাঠানো হয়েছিল। সেসব তৎপরতার ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে মস্কো। তখন দনবাসের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে নেয় রুশ বাহিনী।

আজকের দিনে দনবাসের প্রায় ১৭ হাজার ৯৮০ বর্গমাইল বা প্রায় ৮৮ শতাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে। এর মধ্যে লুহানস্কের প্রায় পুরোটা ও দোনেৎস্কের চার ভাগের তিন ভাগ রুশ বাহিনীর দখলে রেখেছে। দোনেৎস্কে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর ও সুরক্ষিত অবস্থান নিজেদের দখলে রেখেছে ইউক্রেন বাহিনী। সেগুলো রক্ষা করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ফাইল ছবি: রয়টার্স

দনবাস কোথায়, পুতিন কেন এটি চান

দনবাস দোনেৎস্ক অববাহিকায় অবস্থিত। পূর্ব ইউক্রেনের এই অঞ্চলটি কয়লা ও ভারী শিল্পে সমৃদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরে দনবাস ইউক্রেনের অন্যতম রুশভাষী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ার অনেক নাগরিক এখানে শ্রমিক হিসেবে আসেন। সেই সূত্র ধরে রুশ ভাষাভাষীদের আগমন ঘটে। তৎকালীন কয়লাখনি ও ইস্পাত কারখানাগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।

২০১৪ সালে ক্রেমলিন-সমর্থিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি দোনেৎস্কে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ অঞ্চলেই তাঁর রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন। এরপর দনবাস সংঘাতের কেন্দ্রে চলে আসে। মস্কো ক্রিমিয়া দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে স্বঘোষিত পিপলস রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দনবাসের বাসিন্দাদের সুরক্ষাকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর মূল যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন পুতিন। টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বঘোষিত পিপলস রিপাবলিকগুলো মস্কোর সাহায্য চেয়েছে। সেখানে রুশভাষীরা কিয়েভের হাতে ‘গণহত্যার’ শিকার হচ্ছেন বলে দাবি করেন পুতিন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফাইল
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফাইল ছবি: রয়টার্স

রুশরা দনবাসকে যেভাবে দেখেন

বহু বছর ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম দনবাসের প্রতি মানুষের সহানুভূতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দেখানো হচ্ছে—সেখানকার রুশভাষী জনগণের প্রতি বৈষম্য করছে ইউক্রেন সরকার। তবে এ প্রচারণা কখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় পরিসরে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ইউক্রেনে হামলার আগে করা বিভিন্ন স্বাধীন জরিপে দেখা যায়, তখন রুশ জনগণের চার ভাগের মাত্র এক ভাগ দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়ায় সঙ্গে সংযুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, দনবাসের মানুষকে রক্ষা করার যে ঘোষিত লক্ষ্য পুতিনের রয়েছে, তা সমর্থন করছেন বেশির ভাগ রুশ। এই ভূখণ্ডগুলো এখন তাঁরা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষে।

পুতিনের আকাঙ্ক্ষা কি শুধু দনবাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে

শুক্রবার আলাস্কার বৈঠকে ট্রাম্পকে পুতিন বলেছিলেন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিনিময়ে তিনি ইউক্রেনে অভিযান বন্ধ করবেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ ইউক্রেনে খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে সম্মুখসারি বরাবর যুদ্ধ থামাবেন। এই দুই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে রয়েছে।

এর আগেও পুতিন বারবার বলে এসেছেন, তিনি দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চান। ২০২২ সালে শরৎকালে এই চার অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে গণভোটের মাধ্যমে যুক্তও করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া খারকিভ, সুমি ও চেরনিহিভ অঞ্চলের ভেতরে তথাকথিত ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন।

ক্রেমলিনের সাবেক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘পুতিন সুযোগসন্ধানীর মতো আচরণ করছেন। যুদ্ধ শুরুর সময় তাঁর মনে কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা (দখলের উদ্দেশ্য) ছিল না। একবার সফলতার স্বাদ পেয়ে তাঁর লোভ বেড়ে গেছে।’ ইউক্রেনের পক্ষ থেকেও সতর্ক করে বলা হয়েছে, কিয়েভ দনবাসের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলে স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের মতো শহর ব্যবহার করে মধ্য ইউক্রেনের আরও গভীরে হামলা চালাতে পারে রাশিয়া।

দ্য গার্ডিয়ান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.