রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ আসন্ন

0
151

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদিকে মানুষের রক্ত ঝরেছে, অন্যদিকে আলোড়ন চলেছে বিশ্বজুড়ে। সেই জটিল ও কঠিন সময়ের আঁচ দিতে সমকাল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা নথি এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রকাশিত বই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭১-এর ৩ মার্চের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব ও পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের বাছাই অংশ। অনুবাদ ও গ্রন্থনা– ফারুক ওয়াসিফ

একাত্তরের মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপর নিবিড় মনোযোগ রেখে চলছিল। প্রতিদিনের পরিস্থিতি কেবল দেশ দুটির পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগেই নয়, জানানো হচ্ছিল মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্বকে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অনুলিপি চলে যাচ্ছিল সিআইএর পোল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, করাচি, লাহোর ও কলকাতার কর্মকর্তাদের কাছে।

২ মার্চের প্রতিবেদনটি তৈরি করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোনাথন গ্রিনভাল্ট। তাঁরা এটি পাঠান রাজনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট আলেক্সিস জনসনের কাছে। দুঃখের বিষয়, তিন পৃষ্ঠার এই গোপন প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।

৩ মার্চের প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের তীব্র অসন্তোষের কথা বলার পর ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর রাজনৈতিক চরিত্রের তুলনা করা হয়। এবং গৃহযুদ্ধ যে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, সেই আশঙ্কা জানানো হয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা নেবে, কতটা জড়াবে-না জড়াবে– তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল। নিচে প্রতিবেদনের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো:

এটা আগাম বলা অসম্ভব যে এই পর্যায়ে এসে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ কী করবে। মনে হয় না, তারা ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরে আসবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস ও স্বার্থগুলোর যে অবস্থা, তাতে এখন যে কোনো ধরনের আপসে আসা খুবই কঠিন। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ইয়াহিয়া রক্ষণশীল এবং ভুট্টো বামপন্থি ও জনতুষ্টিবাদী। তাই তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের বিপক্ষে হলেও আসন্ন যে কোনো সরকারে কেউই একে অপরকে প্রধান অবস্থানে দেখতে চান না। রহমানের চিন্তা পুরোপুরি পূর্ব পাকিস্তানকেন্দ্রিক এবং তিনি স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আপসে নারাজ। কেননা, তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় আগ্রহী। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর বাড়তি সংঘাতের জায়গাও এটি, কেননা উভয়েই ভারতের প্রতি কঠোর মনোভাবাপন্ন। আপসের সম্ভাবনা সম্ভবত খুবই সামান্য এবং রহমান হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন যে, পাকিস্তানি ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলার সময়ও (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১–অনুবাদক) এই চিন্তা তাঁর মাথায় ছিল এবং স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য এবং বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন সামরিক পন্থায় দমনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আশা করেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুবই সজাগ যে, জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করার মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শক্ত প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। কিন্তু সম্ভবত তিনি ভেবে নিয়েছিলেন, স্থগিত করার বিকল্প হবে আরও খারাপ। তিনি হয়তো দুটি মূল বিকল্প দেখেছেন: ১. অধিবেশন স্থগিত করা এবং কৌশলের জন্য কিছু জায়গা রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাৎক্ষণিক সংঘাতে জড়ানো; অথবা ২. অধিবেশন হতে দেওয়া, তাঁর সেনাবাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে তাৎক্ষণিক সংঘাতে জড়ানো। তিনি জানতেন যে, শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রত্যাখ্যান করবেন এবং কয়েক মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন।

ইয়াহিয়া যেমন মুজিবের সঙ্গে সমঝোতা করতে অক্ষম, তেমনি ভুট্টোর ঘনিষ্ঠও হতে পারবেন না। তা করলে তিনি নিজের ক্ষমতার ভিত্তি এলোমেলো করে ফেলবেন এবং সেনাবাহিনীর আরও কঠোর অংশ তাঁকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করবে। তারা প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের দিকে যাত্রার অবসান ঘটাবে এবং খুব সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানকে বিস্তৃত ও নিয়ন্ত্রণের অতীত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। সংক্ষেপে, ইয়াহিয়া হয়তো তাঁর এবং পাকিস্তানের ক্ষতি কমানোই একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

সংক্ষেপে, ইয়াহিয়া এখন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন এই ক্ষীণ আশা নিয়ে যে, তিনি যদি সব দলকে একেবারে কিনারে ঠেলে দেন, তাহলে হয়তো পাকিস্তানের ভাঙন ঠেকাতে তারা কোনো সমঝোতায় আসতেও পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-রাজনৈতিক শক্তির যা মনোভাব তাতে তিনি আর কোনো বাস্তববাদী উপায় দেখতে পাননি।

মার্কিন নীতি

আপনি জানেন, এই পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করেছি নিরপেক্ষ থাকতে এবং না জড়াতে। আমাদের অবস্থান হলো এই যে, আমরা পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে এবং তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার দায়িত্ব পাকিস্তানিদের ওপরই বর্তায়। এখানে অন্তত একটি তাত্ত্বিক বিকল্প রয়েছে (সিআইএর একটি অংশ এটা মনে করে) যে, ইয়াহিয়াকে তৃতীয় পথের জন্য তাগাদা দেওয়া; যেখানে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভুট্টোর বিরুদ্ধে চালিত করবেন এবং শেখ মুজিবকে ধারণের চেষ্টা করবেন। কিন্তু এটা পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র বিরোধিতা উসকে দেবে, এমনকি সেনাবাহিনীর ভেতরেও। যুক্তরাষ্ট্র এভাবে জড়াতে চায় না। সমস্যাটি তাই উন্মুক্তই রয়ে গেল।

এসবের বাইরে আমাদের দুটি প্রশ্ন রয়েছে:

– যুক্তরাষ্ট্র কি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ধরা বাজি রক্ষা করবে?

– যদি বিচ্ছিন্নতা হয়, তাহলে রক্তপাত এড়ানোর চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র কতটা সক্রিয় হবে?

সম্ভাব্য ঘটনাবলি মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা শেষ হওয়া উচিত। কার্যত আমরা এশিয়ার এক অস্থিতিশীল অঞ্চলে সাত কোটি মানুষের নতুন এক রাষ্ট্রের সম্ভাব্য জন্ম সাক্ষ্য করছি। এটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ঘটতে পারে, তার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত, নতুবা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ আসন্ন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.