যেভাবে পেঙ্গুইনের কাছে পৌঁছাল সূর্যমুখীর গল্প

0
189
বই হাতে ইফফাত নাওয়াজ

প্রায় দুই বছর ধরে একটু একটু করে লেখার পর ২০১৮ সালে সূর্য’স ক্ল্যান-এর প্রথম খসড়া লিখে শেষ করেন ইফফাত নাওয়াজ। ওই বছরই কনিষ্ক গুপ্ত নামের এক ভারতীয় লিটারেরি এজেন্টের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। উপমহাদেশের প্রকাশনার জগতে কনিষ্ক গুপ্ত পরিচিত এক নাম। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় লিটারেরি এজেন্সি রাইটার্স সাইডের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। সাম্প্রতিক সময়ে বুকারজয়ী কথাসাহিত্যিক গীতাঞ্জলি শ্রী, ডেইজি রকওয়েল, শিহান করুণাতিলকসহ আরও অনেক দক্ষিণ এশীয় লেখকেরই তিনি লিটারেরি এজেন্ট। এই কনিষ্ক গুপ্ত ইফফাতের উপন্যাসের প্রথম খসড়া পড়লেন, পছন্দ করলেন, কিছু পরামর্শও দিলেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এখনো লিটারেরি এজেন্ট অপরিচিত বিষয়। তাই ইফফাতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, লেখকের জন্য একজন লিটারেরি এজেন্ট থাকাটা কতটা জরুরি। উত্তরে তিনি জানালেন, ‘একজন ভালো এজেন্ট থাকা মানে তোমার নতুন আইডিয়া, নতুন লেখা প্রকাশনীর কাছে পৌঁছানো, তাদের পরামর্শগুলো তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা একজন দায়িত্ব নিয়ে করছেন। বই প্রকাশের পর তোমার বইটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনেকটা অংশ, পাঠকের মতামতের দিকে খেয়াল রাখার বিষয়টা একজন তোমার হয়ে দেখছেন।…লেখালেখি তো একটা সৃজনশীল কাজ। এর পুরোটা শেষ করে প্রকাশনার কাজটাও যদি লেখককে করতে হয়, সেটা আসলে খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এজেন্ট থাকলে একদিকে প্রকাশনা জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ একজনের পরামর্শ যেমন তুমি পাচ্ছ, তেমনি তোমার সৃজনশীলতার ওপর চাপটাও কমছে।’

২০২০-এ ইফফাত নাওয়াজের লিটারেরি এজেন্ট হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হলেন কনিষ্ক গুপ্ত। সেটা মহামারির শেষ দিকের কথা। সব বিশ্বের প্রকাশনা জগতেই তখন খুব ব্যস্ত সময় চলছে। প্রচুর মানুষ মহামারির সময়ে বই লিখেছেন, সেগুলো একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। ইফফাত ও কনিষ্ক, দুজনই তাই সময়সাপেক্ষ এক প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ২০২০ সালেই সূর্য’স ক্ল্যান-এর পাণ্ডুলিপি পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস, পিকাডিলি পাবলিশিং, হ্যাচেট ইন্ডিয়া পাবলিশার্সসহ অনেকগুলো নামী প্রকাশনা সংস্থাকে পাঠানো হলো। প্রথম উত্তরটা এসেছিল ওই বছরই হ্যাচেট ইন্ডিয়ার কাছ থেকে। কিন্তু কিছুদিন পর আর সেখান থেকে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ইফফাত বললেন, ‘আমি হতাশই হয়েছিলাম। নিজে প্রকাশ করার কথা আমি কখনো ভেবে দেখিনি। শুধু ভাবছিলাম, এখান থেকে না হলে আর কীভাবে বইটা প্রকাশ করা যায়।’

হঠাৎই ২০২১-এর জানুয়ারিতে পেঙ্গুইন থেকে দুজন সম্পাদক সূর্য’স ক্ল্যান নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁদের একজন পেঙ্গুইন ভিন্টেজের সম্পাদক এলিজাবেথ পুরোভিলা। সপ্তাহান্তের এক ছুটিতেই ইফফাতের পাণ্ডুলিপিটা পড়ে শেষ করেছিলেন এলিজাবেথ। তারপরই তিনি বইটি প্রকাশের আগ্রহের কথা জানিয়ে কনিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবু মনে শঙ্কা ছিল। নাওয়াজের মনে হয়েছিল, সম্পাদকের পছন্দ হলেও হয়তো বাজার গবেষণা বলবে বইটা তেমন বিক্রি হবে না, বিপণন বিভাগের সিদ্ধান্তে আটকে যাবে বই। অথবা হয়তো প্রকাশনার সব প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে। সেসব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে আদৌ বই বের হবে কি না, তাই-বা কে জানে!

যেভাবে পেঙ্গুইনের কাছে পৌঁছাল সূর্যমুখীর গল্প

সম্পাদক এলিজাবেথ কিন্তু ইফফাত এবং তাঁর উপন্যাসের ওপর ভরসা হারাননি। তিনিই সিদ্ধান্ত নেন, পেঙ্গুইন প্রিন্টের পেপারব্যাক নয়, বরং পেঙ্গুইন ভিন্টেজের হার্ড কাভার হিসেবে প্রকাশিত হবে সূর্য’স ক্ল্যান। এলিজাবেথের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রাক্কালে দৃশ্যপটে আবার ফেরত এল হ্যাচেট ইন্ডিয়া। এবার তাঁদের ভিন্ন সুর, কিছুটা বেশি অর্থ দিয়ে হলেও তাঁরা ইফফাতের বইটি প্রকাশ করতে আগ্রহী। লেখকের কাছে জানতে চাইলাম, পেঙ্গুইন বনাম হ্যাচেট দ্বৈরথে পেঙ্গুইন জয়ী হলো কীভাবে। হাসতে হাসতে ইফফাত উত্তর দিলেন, ‘বিষয়টা তো কখনোই অর্থের ছিল না।…আমরা ছোটবেলা থেকে পেঙ্গুইনের বই পড়ছি, বাড়ির বুকশেলফে দেখেছি পেঙ্গুইনের লোগোওয়ালা সারি সারি বই। এত স্মৃতির সঙ্গে পেঙ্গুইন জড়িয়ে আছে যে…আমি চাইছিলাম আমার বইটা পেঙ্গুইন থেকেই আসুক।’

আগেই বলেছি, পেঙ্গুইনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর প্রকাশনা প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে, এমন একটা শঙ্কা ইফফাত নেওয়াজের ছিল। তবে তাঁকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে প্রকাশনার পরবর্তী যাত্রাপথটি হলো খুবই মসৃণ। প্রুফরিডিং ছাড়া তেমন কোনো সম্পাদনাই করলেন না এলিজাবেথ পুরোভিলা। এ সম্পর্কে ইফফাত বলেন, ‘একজন গুণী সম্পাদকের সঙ্গে বই সম্পাদনা করার অভিজ্ঞতাটা হয়তো এ যাত্রায় আমার হলো না। আমি যেভাবে লিখেছিলাম, এলিজাবেথ বইটি ঠিক সেভাবেই রাখলেন। এটা আমার কাছে খুব আনন্দের। অবিশ্বাস্য! আমার নিজের জন্য একটা মাইলস্টোন বলতে পারো।’ অতঃপর ২০২২-এর নভেম্বর মাসে পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস থেকে ঝকঝকে প্রচ্ছদে সূর্যমুখী ফুলের ছবি নিয়ে প্রকাশিত হলো ইফফাত নাওয়াজের লেখা প্রথম উপন্যাস সূর্য’স ক্ল্যান

ইফফাত নাওয়াজের কাছে যখন জানতে চাইলাম, বাংলাদেশের নতুন লেখকেরা কীভাবে বৈশ্বিক এই প্রকাশনী সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারেন, তিনি আশার কথাই শোনালেন, ‘কনিষ্ক এবার আমার সঙ্গে ঢাকা লিট ফেস্টেও গেল, তাতে ঢাকার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগটা হলো। এ ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করাটা খুব জরুরি। আসলে নিজেকে পৃথিবীর কাছে মেলে ধরার সাহসটা থাকতে হবে। ইউ হ্যাভ টু পুট ইয়োরসেলফ আউট দেয়ার! তারপর দেখা যাক কী হয়।’

তাবাসসুম ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.