যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিবাদে কয়েক সপ্তাহ ধরে সরব প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরা গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন।
এ প্রতিবাদের জেরে হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে।
স্নাতক অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক দিন আগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভকারীদের তাঁবুর অস্থায়ী শিবিরগুলো অপসারণে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু গাজায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে শিক্ষার্থীরা কেনই-বা এত প্রতিবাদমুখর, তা জেনে নেওয়া যাক:
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলা ও পরে গাজায় শুরু করা ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকভাবে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ, অবস্থান, অনশনের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁবুর শিবির গড়ে টানা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মূলত দাবি, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ যেন ইসরায়েলকে সরবরাহ করা অস্ত্রের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ না করে এবং তাদের কাছ থেকে কোনো তহবিল বা সুবিধা না নেয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গণহত্যা থেকে বিচ্ছিন্ন’ থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইসরায়েলের ভেতরে বা দেশটির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করছে, এমন মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের সহকর্মী। আর তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের তাঁবুর শিবিরগুলো অপসারণ ও একটি একাডেমিক ভবন থেকে তাঁদের হটিয়ে দেয় পুলিশ। ভবনটি দখল করে রেখেছিলেন তাঁরা।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার আগে দুই তলার হ্যামিলটন হলে প্রবেশ করেন দাঙ্গা পুলিশের সদস্যরা। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে ১১৯ জনের মতো বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে গতকাল বুধবার জানিয়েছেন নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা জন চেল। তিনি বলেন, তাঁদের মধ্যে কতজন এখানকার শিক্ষার্থী আর কতজন ‘বাইরে থেকে আসা উসকানিদাতা’, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দানা বাঁধে এপ্রিলের শুরুতে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মিনুচে শাফিক ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিরোধিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেন। একই সময় আপার ম্যানহাটান ক্যাম্পাসে তাঁবু ফেলেন শত শত শিক্ষার্থী।
পরদিন ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনাও বিক্ষোভের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়। বরং এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হয় বিক্ষোভ। কলাম্বিয়ায় বাতিল করা হয় ক্লাস।
সংকট সমাধানে আলোচনা ব্যর্থ হলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন বিক্ষোভকারীরা দখলে নিলে কর্তৃপক্ষ আবারও পুলিশ ডাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, হলটি ভাঙচুর করা হয়েছে। আরও বিক্ষোভ ঠেকাতে চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান করবে পুলিশ।
যা হয়েছে ইউসিএলএতে
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে (ইউসিএলএ) মঙ্গলবার রাতে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান একদল ইসরায়েল-সমর্থক। এ সময় উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় ইসরায়েল-সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠি ও ব্যাট নিয়ে চড়াও হন। শিবিরের প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিন্ন করার চেষ্টা চালান তাঁরা। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সহিংসতার সময় পুলিশ ধীরে সাড়া দিয়েছে।
সহিংস ঘটনার জেরে গতকাল ক্লাসগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন ইউসিএলএ কর্মকর্তারা।
আর কোথায় কোথায় বিক্ষোভ
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও তাঁবুর অস্থায়ী শিবির গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জুগিয়েছে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটি জর্জ ওয়াশিংটন, ব্রাউন, ইয়েল, হার্ভার্ড, এমারসন, এনওয়াইইউ, জর্জটাউন, আমেরিকান, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, জনস হপকিনস, টাফটস, কর্নেল, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, প্রিন্সটন, টেম্পল, নর্থইস্টার্ন, এমআইটি, দ্য নিউ স্কুল, ইউনিভার্সিটি অব রোচেস্টার, ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ।
এ ছাড়া আছে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস, ইউনির্ভাসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, নর্থওয়েস্টার্ন, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি সেন্ট লুইস, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ওহাইও স্টেট, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, মায়ামি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ওহাইও, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, এমোরি, ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা, ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া এথেন্স, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস।
বিক্ষোভ কি কাজে আসছে
ক্যাম্পাসের ফিলিস্তিনপন্থী গ্রুপগুলো অনেক বছর ধরে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইসরায়েলকে বয়কট করা, দেশটির প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ না করা ও নিষেধাজ্ঞার (বিডিএস) পদক্ষেপে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এর উদ্দেশ্য ইসরায়েলকে তার তৎপরতা থেকে পিছু হটানো।
নিষেধাজ্ঞার আহ্বানে এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় সাড়া দেয়নি। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অতীতে ইসরায়েলের সঙ্গে নির্দিষ্ট খাতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে দেখা গেছে।
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বন্ধের কোনো প্রভাব গাজা যুদ্ধের ওপর যদি পড়েও, তবে তা সামান্য। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, বিনিয়োগ বন্ধ হলে তা এ যুদ্ধ থেকে যাঁরা মুনাফা করছেন, তাঁদের ওপর ছায়া ফেলবে ও তাঁদের (বিক্ষোভকারী) দাবির বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সাহায্য করবে।
স্মরণে আসছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে বিক্ষোভের কথা
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে গত শতকের ষাটের দশকের শেষ ভাগে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেটিই এবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কলাম্বিয়াসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলন।
চলতি বিক্ষোভে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। পুলিশের সঙ্গেও হয়েছে সংঘর্ষ।
১৯৭০ সালে ওহাইওতে বিক্ষোভে ন্যাশনাল গার্ডের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন চার শিক্ষার্থী। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট ও বন্ধ হয়ে যায় কয়েক শ বিশ্ববিদ্যালয়।