মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরাকে যুক্ত করে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। ২০০৯ সালে নকশা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। সেই থেকে এ প্রকল্পে শ্রম দিয়েছেন দেশি-বিদেশি ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক। গত বছর যখন এ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়, তখন ক্লান্তি ভুলে তাঁদের চোখে ছিল খুশির ঝিলিক। দেশি শ্রমিকরা বলছেন, তাঁদের অনেকেই এ কাজে যুক্ত হয়েছিলেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ইতিহাসের অংশ হতে। এ জন্য অনেক ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে।
পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সড়কের নিচে সম্প্রতি কাজে ব্যস্ত ছিলেন মো. শাহীন। তিনি সেতুর কাজে শুরু থেকেই যুক্ত। আগে নিচে কাজ করেছেন, পরে ওপরে ওঠেন। শাহীন বলেন, ‘কর্মকর্তারা যখন যে কাজ দেন, তা-ই করি।’ তাঁর ভাষ্য, ভারী যন্ত্রপাতির কাজে অনেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এরপরও নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা থেকে এ কাজে জড়িয়েছেন।
সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় ঢুকতেই নজরে পড়ে কর্মীদের ব্যস্ততা। সেতুর দুই পাশে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। মাঝেমধ্যে তাঁদের কর্মকাণ্ড তদারক করছেন চীনা কর্মকর্তারা। সবার মাথায় সবুজ হেলমেট, মুখে মাস্ক। কাজে ব্যস্ত ছিলেন গাইবান্ধার মো. শরিফ। প্রায় আট বছর এ প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন। শরিফ বলেন, প্রথমে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতেন। পরে ফোরম্যান হন। তাঁর অধীনে ছয়জন কর্মী ছিলেন, যাঁরা যে কোনো কাজেই পারদর্শী।
শুরুর দিকে চীনা কর্মকর্তাদের ভাষা বুঝতে সমস্যায় পড়তে হতো জানিয়ে শরিফ বলেন, ‘এতে কাজেও ভুল হয়েছে। কিছুদিন পর তাঁদের (চীনা) ভাষা বুঝতে পারায় ভালো কাজ করতে পেরেছি।’ কাজ ভালো করলে প্রশংসাও পেয়েছেন। শরিফের সবচেয়ে ভালো লাগা কাজ করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ইতিহাসের অংশ হতে পেরে।
মাওয়া প্রান্তে মূল সেতুর এক নম্বর পিলারের পাশে কাজ করছিলেন শহীদ তালুকদার। তিনি বলেন, সেতুর পিলার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি পিলারকে কেন্দ্র করে ফোরম্যানের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন দল আলাদা আলাদা কাজ করেছে। এক নম্বর পিলারের কাছে পাঁচজন ফোরম্যানের অধীনে ১১০ থেকে ১২০ জন কর্মী ছিলেন। তাঁরা ওপরে সড়ক ও রেলপথের স্ল্যাব বসিয়েছেন। এরপর রেলিং ও প্যারাপেট ওয়াল তৈরি করেন। শেষে করেন পিচ ঢালাই। সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হওয়ার পর তাঁদের শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
দিন-রাত তিন শিফটে কাজ করেন দেশি-বিদেশি শ্রমিক-প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের কারও চোখে-মুখে ছিল না ক্লান্তি। আনন্দের ঝিলিক দেওয়া চোখে ছিল অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সাহস। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার ভাষ্য, শ্রমিকদের মেহনতের ঘাম ও নিষ্ঠার গাঁথুনি যেন বহুমুখী এ সেতুকে আরও মজবুত করেছে।
পদ্মা সেতুর বিশাল এ কর্মযজ্ঞে কত শ্রমঘণ্টা ব্যয় হয়েছে– এর সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) কর্মকর্তাদের কাছে। তবে কত শ্রমিক কাজ করেছেন, এর তথ্য পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫০০ কর্মী নিয়ে ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি নকশা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার কর্মী যুক্ত ছিলেন। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ২০ হাজার কর্মী কাজ করেন। পরে কাজের চাপ কমে যায়। শ্রমিক সংখ্যাও কমতে থাকে। ২০১৯ সালের পর মাসে সাড়ে চার হাজার কর্মী পদ্মা সেতুর কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা চার হাজার। বাকি ৫০০ জন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, কলম্বিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নেপাল, তানজানিয়াসহ বিশ্বের ২২টি দেশের নাগরিক।