মৃত্যুর ১৫ মিনিট আগেও ছাত্রদের ডেকে ডেকে পানি দিচ্ছিলেন মুগ্ধ

0
53
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ

তাঁর ফেসবুকজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে লেখা অসংখ্য স্ট্যাটাস। তাতে বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে তৈরি হওয়া ক্ষোভের ‘আগুন’। মৃত্যুর আগের দিন সারাদেশে হামলা, রক্তাক্ত ছবি দেখে লিখেছিলেন ‘এই আহাজারি সইতে পারছেন তো’।

সেই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধকে নিয়েই এখন আহাজারি চলছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সবার মাঝে। ক্যাম্পাসের প্রিয় মুখকে হারিয়ে কাঁদছেন তারা। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান মুগ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ভালো খেলোয়াড়, গায়ক, সংগঠক হিসেবে গত চার বছর ধরে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ক্যাম্পাসে। গণিতে স্লাতক শেষ করে গত মার্চে ঢাকায় যান। এমবিএতে ভর্তি হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)।

মৃত্যুর মাত্র ১৫ মিনিট আগে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সড়কে ছোটাছুটি করছেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে হাতে পানি ভর্তি বাক্স ও বিস্কুট নিয়ে ছুটছেন মুগ্ধ। ছাত্রদের ডেকে ডেকে বলছেন, ‘পানি লাগবে কারও, পানি’? ভিডিওতে দেখা গেল, অনেকেই তাঁর কাছ থেকে পানি পান করছেন। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজাল ধোঁয়ায় বেশ কয়েকবার চোখ মুছতে দেখা গেল মুগ্ধকে।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মুগ্ধর সঙ্গে থাকা বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক বলেন, ‘কারও বিপদ দেখলে সব সময় ছুটে যেতেন মুগ্ধ। উত্তরায় ছাত্রদের ওপর হামলা হচ্ছে শুনে অন্য বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যান তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। ওই দিন অনেককেই হাসপাতালে নিয়ে গেছি আমি ও মুগ্ধ। বিকেল ৬টার দিকে ছাত্রদের মাঝে পানি ও বিস্কুট দিয়ে সড়ক ডিভাইডারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ রাজউক কমার্শিয়ালের সামনে থেকে পুলিশ গুলি করতে করতে এগিয়ে এলে সবার সঙ্গে আমরাও দৌড় দিই। হঠাৎ দেখি গুলি লাগায় সড়কে পড়ে গেছে মুগ্ধ। তাঁর কপালে গুলি লেগে ডান কানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

মুগ্ধর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জন্ম ১৯৯৮ সালে উত্তরায়। দাফন হয়েছে এখানেই। উত্তরার ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটিতে প্রাথমিক এবং উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড়, গায়ক, গিটারিস্ট ও সংগঠক হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান শিক্ষা সমাপনী-২০২৩-এর কনভেনর ছিলেন। ছিলেন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার। শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিলেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ ছিলেন যমজ। বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত বলেন, পরিবারে সবার আদরের ছিল মুগ্ধ। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত সে। এমবিএর পাশাপাশি দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস করছিল। কিন্তু সব কিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে, কে জানত!

মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে মায়ের সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখত মুগ্ধ। সব সময় মাকে দেখেশুনে রাখত। ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের খরচ চালাত। মা এখনও কাঁদছেন। বাবা চুপচাপ হয়ে গেছেন।’

খুবির গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ আবদুস সামাদ বলেন, অসাধারণ ছেলে ছিল মুগ্ধ। কারও সঙ্গে কখনও গোলমাল, বেয়াদবি করতে শুনিনি। ক্লাসে ওকে বকা দিলে এমনভাবে হেসে দিত, পরে ওকে আর কিছু বলতে পারতাম না।

ক্যাম্পাসে মুগ্ধর জুনিয়র মুহিব্বুল্লাহ বলেন, ‘যে কোনো আয়োজনে সামনের সারিতে থাকতেন মুগ্ধ ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আগে আন্দোলনে আমরা সক্রিয় ছিলাম। ঢাকায় থেকে তিনি আমাদের সাহস দিতেন।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে চতুর্থ বর্ষের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ক্যাম্পাস খুললে খুবির প্রধান ফটকের নাম ‘শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ফটক’ করার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানাবেন তারা।

হাসান হিমালয়, খুলনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.