মূল্যস্ফীতির হার গত ডিসেম্বরে ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও তা অর্জন সম্ভব হয়নি। তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা চাপ থাকলেও মূল্যস্ফীতিই বর্তমানে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গতকাল সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাল্টিপারপাস হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ মন্ত্রণালয়ের চারজন সচিব ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অর্থমন্ত্রী। দেশের বর্তমান অর্থনীতির চিত্র অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করার সময় এমন মন্তব্য করেন তারা। এদিন ছিল নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম কার্যদিবস।
পরে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, আছে। একে মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে রাতারাতি সব সংকট দূর করা যাবে না। বিষয়গুলো বুঝতে তাঁরও কিছুটা সময় প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সময় দিতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় একা পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। রাতারাতি সবকিছু ঠিক করা যাবে না। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেবেন তিনি। একই সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে কাজ করা হবে। টাকার মূল্যমান নিয়েও কাজ করবেন তিনি। সার্বিকভাবে সবাইকে নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করবেন।
এর আগে গভর্নর আব্দুর রউফ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক ভালো থাকলেও বাড়তি মূল্যস্ফীতিই বর্তমানে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কমানোর জন্য ইতোমধ্যে নীতি সুদহার, ব্যাংকের ঋণ ও আমানতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি একবার দ্রুত বেড়ে গেলে সহজে তা কমে না। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে না নামা পর্যন্ত সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত থকবে।
গভর্নর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলার সংকটে আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সম্প্রতিক সময়ে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে সমস্যা তৈরি হলেও গত কয়েক মাসে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে বাড়তি খেলাপি ঋণ এবং সুশাসনে ঘাটতি থেকে উত্তরণকে বিশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, দেশের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক দেশের চেয়ে কম। অর্থনীতির উন্নয়নে রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য এনবিআর করের আওতা বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। একই সঙ্গে অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকারের বাজেট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই রাখা সম্ভব হচ্ছে। তবে বাস্তবায়নের হার বাড়াতে হবে।
টানা ১০ মাস ৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে ৮ শতাংশের ঘরে মূল্যস্ফীতি নেমে আসবে। কিন্তু গতকাল প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্যমতে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ১০ মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডিসেম্বরে খাদ্যপণ্যের ম্যূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে কিছুটা কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি এখনও ১০ শতাংশের ওপরে। এ মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা নভেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ডিসেম্বরেও শহরের তুলনায় গ্রামের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। গ্রামের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা শহরে ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এদিকে দায়িত্ব পেয়ে দপ্তরে আসার প্রথম দিনই ভোক্তাবান্ধব দ্রব্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনার’ এক গুচ্ছ পরিকল্পনা সামনে আনলেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পদ্ধতি চালু, ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে অগ্রাধিকারমূলক চুক্তি, পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় ডিজিটাল নজরদারি, সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমে রেশনিং পদ্ধতি চালুসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন।
তিনি বলেন, কোনো ভয়ভীতি দেখিয়ে নয়; সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই আমরা দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। তেল, চিনি, লবণ, কৃষিপণ্য, ডাল– এসব নিয়ে যারা কাজ করে, তারা যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করে– সেটা আমরা নিশ্চিত করব। পণ্য আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কোনো কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য কঠোর তদারকি করা হবে। কেউ কারসাজি করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজারমূল্য ঠিক রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করার পরিকল্পনার কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের মজুতদারি আমরা শক্ত হাতে দমন করব। যারা এসব করে, তাদের আমি ব্যবসায়ী বলব না। তারা অসাধু কিছু গোষ্ঠী। কোথাও মজুতদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট দেখলে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেব। যারা ভালোভাবে ব্যবসা করবে, তাদের আমরা সহযোগিতা করব। আমরা চাই নিত্যপণ্যগুলো যেন মানুষের জন্য সহজলভ্য থাকে।
রোজার মাস সামনে রেখে দেশে সব ধরনের পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে বলেও জানান নতুন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, রোজার আর ৬০ দিন বাকি। কোনো পণ্যের ঘাটতি আছে বলে আমাদের জানা নেই।