যে কোনো আর্থিক পতনের আগে শক্ত প্রবিধানবিরোধী লবিস্টরা সক্রিয় হন। তাঁদের একটা সাধারণ প্রবণতা হলো: তত্ত্বাবধান, নিষেধাজ্ঞা, রিপোর্টিং ও পর্যবেক্ষণের মতো বিষয়কে ঘৃণা করা। তাঁরা হলেন সীমান্তের অবতার, বন্দুক বহনকে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতীক মনে করেন এবং তা দিয়ে নেটিভদের হত্যা করেন; কোনো প্রকার কাগজের জটিলতা, কমপ্লায়েন্স ও আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা ছাড়া সম্পদের মালিক হওয়ার পথ খোঁজেন।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) পতন হলো। একটা সময় পর্যন্ত স্টার্টআপগুলোর জন্য বেশ পছন্দের এক ব্যাংক ছিল এটি, সেই চাষবাসেরই তিক্ত ফল। ২০০৮ সালে ওয়াশিংটন মিউচুয়াল (ওয়ামু) ভেঙে পড়ার পর মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘটনা এটা। অথচ এর তিন দিন আগেও ব্যাংকিং সেক্টরের লবিস্টরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। কারণ তাঁরা বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাকে তাঁদের পাশে পেয়েছিলেন, যাঁরা এই সওয়াল করছিলেন– আর্থিক খাতের নিয়মনীতি কঠোর করার পক্ষে ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ার জেরোম পাওয়েলের কাছে কোনোই কারণ থাকার কথা নয়।
তাঁদের কাছে আর্থিক খাতের পরিবেশ খুব কঠোর মনে হচ্ছিল এবং এটা আরও সহজ করার প্রয়োজন বোধ করছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই চেষ্টার পক্ষে যুক্তি ছিল– ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অর্জিত প্রণীত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রক ত্রাণ এবং ভোক্তা সুরক্ষা আইনের কিছু ইতিবাচক ফল। তখন প্রতিনিধি সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা কেভিন ম্যাকার্থি ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবর্তিত ডড-ফ্রাংক ব্যাংকিং ব্যবস্থা গুটিয়ে ফেলার বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সেই আগ্রহ অনেকাংশেই বাস্তবায়িত হয় ২০১৮ সালে।
বিশেষত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের লবিস্টরা সেই চেষ্টায় বেশি সক্রিয় ছিলেন। এমনকি তাঁরা ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের (এফডিআইসি) নিয়ন্ত্রণ থেকে অব্যাহতি পর্যন্ত চেয়েছিলেন। এফডিআইসির কাজ হলো, প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি সংকটের সময়ে ব্যাংকের আমানতের ওপর বীমা নিশ্চিত করা। ম্যাকার্থির দুই সাবেক কর্মী যে এসভিবির জন্য নিবন্ধিত লবিস্ট হতে চলেছেন, এটি তাই কোনো কাকতালীয় নয়। এটি বরং এমন একটি সত্য, যা দেখায় কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘূর্ণায়মান দরজাটি রাজনীতি ও ব্যবসায়ের মধ্যে নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। এসভিবি লবি তালিকায় এমন ব্যক্তিদেরও নাম রয়েছে, যাঁরা সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক রিপাবলিকান সিনেটর মাইক এনজি, সাবেক রিপাবলিকান সিনেটর টম কোবার্ন এবং সাবেক ডেমোক্র্যাট সিনেটর আর্লেন স্পেকটারের অধীনে কাজ করেছেন। চাইলে এ তালিকা আরও লম্বা করা যায়। এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
অতএব, সংকট স্বাভাবিক নিয়মেই এসেছে। ৯ মার্চ স্টার্টআপ এবং সহযোগী পুঁজিপতিরা এসভিবি থেকে আমানত প্রত্যাহার শুরু করেন। কারণ, এর শেয়ারের দাম পড়ে গিয়েছিল। এসভিবি ইতোমধ্যে ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার লোকসানে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে তার বিক্রয়যোগ্য পোর্টফোলিও শেয়ার বিক্রি করেছে। একটি প্যাচ-আপ, মূলধন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় এসভিবি তারপর ঘোষণা করেছে– এটি আরও ২২৫ কোটি ডলার মূল্যের শেয়ার বিক্রি করবে।
পরদিন এফডিআইসি এসভিবিকে রিসিভারশিপে রেখেছিল। করপোরেশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল– বীমাকৃত আমানতকারীদের ১৩ মার্চ তাঁদের বীমাকৃত আমানতের অ্যাকসেস থাকবে; ‘পরবর্তী সপ্তাহের মধ্যে অগ্রিম’ আশা করে, বীমাবিহীন আমানতকারীদের একটু বেশি অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ব্যাংকের আমানতের ৯০ শতাংশ এফডিআইসি দ্বারা গ্যারান্টিকৃত পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে; পর্যাপ্ত পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা অনিশ্চিত প্রমাণিত হয়েছে, অন্তত যতক্ষণ না এফডিআইসি, ফেডারেল রিজার্ভ ও মার্কিন ট্রেজারি তাদের জন্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ডেপুটি ট্রেজারি সেক্রেটারি ওয়ালি আদেয়েমো পরামর্শ দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন, আর্থিক ব্যবস্থা যেমনটি দাঁড়িয়েছে, পতন সংক্রমণ আটকানোর জন্য তা যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক হবে। ‘ফেডারেল নিয়ন্ত্রকরা এই বিশেষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন,’ তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘এবং যখন আমরা বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন আমরা সিস্টেমের সক্ষমতা ও স্থিতিস্থাপকতায় খুব আত্মবিশ্বাসী।’
তবে এটা ভুল হতে বাধ্য; এটি অবশ্যই সাবেক এফডিআইসিপ্রধান শিলা ব্লেয়ারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়, যিনি যুক্তি দেন– সিস্টেমে এমন আরও ব্যাংক রয়েছে, যেখানে প্রচুর পরিমাণে বীমাবিহীন আমানত এবং লোকসানের শঙ্কা রয়েছে। ‘এই ব্যাংকগুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক অ-বীমাকৃত অর্থ রয়েছে … যে কোনো সমস্যায় যা ব্যাংকের বাইরে চলে যাবে।’
ক্রাফ ভেঞ্চার্সের ডেভিড স্যাকসও মনে করেন, সরকারি পর্যায়ে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ‘পাওয়েল কোথায়?’ তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘কোথায় [ইউএস সেক্রেটারি অব দ্য ট্রেজারি জ্যানেট] ইয়েলেন? এই সংকট এখনই বন্ধ করুন।’ এসভিবিকে তিনি প্রস্তাব করেছেন, শীর্ষ চার ব্যাংকের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া উচিত। ‘সোমবার খোলার আগে এটি করুন, না হলে সংক্রামক হবে এবং সংকট ছড়িয়ে পড়বে।’
প্রশ্ন হচ্ছে– ঘুণপোকাটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ খুঁজে পেয়েছে কিনা। গ্যালাক্সি ডিজিটালের প্রতিষ্ঠাতা মাইক নোভোগ্রাটজ ভেবেছিলেন, সব ব্যাংককে এখন হেজ ফান্ডের মতো বিবেচনা করা হচ্ছে কিনা। তাঁর মতে, ‘একটি নীতিগত ভুল বলে মনে হচ্ছে।’
পিটার শিফের মতো অর্থনীতিবিদরা আরও বেশি সিরিয়াস। তাঁরা দাবি করছেন– পুরো ইউএস ব্যাংকিং সেক্টর একটি ক্যাথার্টিক ক্লিনআপের জন্য সেট করা হয়েছে, যা ২০০৮ সালের চেয়েও বেশি হতে পারে। মার্কিন ব্যাংকগুলো ‘অত্যন্ত কম সুদের হারে দীর্ঘমেয়াদি কাগজ ধারণ করেছিল। তারা স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না।’ এ ধরনের পরিবেশে আমানতকারীরা উচ্চ আয় অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে উত্তোলন শুরু করবে। ফলে ব্যাংক ধসের জোয়ার শুরু হবে।
এ অভিযোগ অনেকে না-ও মানতে পারেন; তবে ব্যাংকিং লবিস্টদের ধ্বংসাত্মক রূপ এবং স্থায়ী ক্ষমতা রয়েছে। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল একটি কার্যপত্র প্রকাশ করেছে। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে– ব্যাংক লবিং সাধারণভাবে ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করে, যা কঠোর নিয়ম এবং প্রয়োগের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলস্বরূপ এটি ঝুঁকিপূর্ণ চর্চা এবং খারাপ অর্থনৈতিক ফল সৃষ্টির পথ খুলে দেয়।’
যেমন বড় আর্থিক সংকট দেখিয়েছে, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই দস্যুতার প্রতিষেধক। লুণ্ঠনজীবী এবং বাহাদুরি দেখানো লোকেরা সব সময় এ ধরনের ব্যবস্থা প্রতিরোধ করবে। তারপরও তাদের এমন ধারণার ক্ষতিকর পরিণতি গভীর এবং ব্যাপক বলে প্রমাণিত হতে চলেছে।


















