যুক্তরাষ্ট্র–চীনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীনের পক্ষ নেওয়া এবং পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরে চীনের আগ্রাসী আচরণ সমর্থন করা, বিশেষ করে ফিলিপাইনের দাবি করা ছোট ছোট দ্বীপকে চীনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে দুতার্তে তাঁর ‘নির্মাণ! নির্মাণ! নির্মাণ!’ শীর্ষক অবকাঠামো প্রকল্পে বিশাল অঙ্কের চীনা বিনিয়োগ চেয়েছিলেন। চীন তা দিতে রাজিও ছিল; কিন্তু এ ব্যাপারে বেইজিং নিজেকে বাধ্যবাধকতায় জড়ায়নি। ফলে গত জুনে দুতার্তের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হতেই বেইজিং তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে থাকে। কথা ছিল ফিলিপাইনের অবকাঠামো খাতে চীন ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চীন সেই অর্থের ৫ শতাংশের কম ছাড় করেছে এবং পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরে তার উসকানিমূলক কার্যক্রম আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় দুতার্তের উত্তরসূরি নতুন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোস জুনিয়র অধিকতর বিচক্ষণ কৌশল অবলম্বন করছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের লাগামছাড়া দাবির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন মারকোস জুনিয়র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের আগের অংশীদারি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে ফিলিপাইন তার আরও চারটি সামরিক ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার দিয়েছে (সব মিলিয়ে মোট ৯টি ঘাঁটি), যার কয়েকটির অবস্থান দক্ষিণ চীন সাগরের অমীমাংসিত এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্র–ফিলিপাইন আবার দক্ষিণ চীন সাগরে যৌথ সামরিক মহড়া দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। দুতার্তের সময়ে এই মহড়া ছয় বছর স্থগিত ছিল।
জাপানের সঙ্গেও ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গভীর করছে। এতে ফিলিপাইনের সমুদ্রসীমানায় জাপান আগের চেয়ে বেশি পরিসরে সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া দেওয়ার সুযোগ পাবে। শুধু তা–ই নয়, যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও ফিলিপাইন নৌ মহড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে যৌথ মহড়া দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন সামরিক সহযোগিতামূলক তৎপরতার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠছে। এটি কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে লাভবান করছে, যার জন্য শুধু চীনকেই দায়ী করা চলে। চীন প্রতিবেশী দেশগুলোকে দিনের পর দিন ভয় দেখিয়ে স্বার্থ আদায় করতে চেয়েছে। তার সেই চাওয়া অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, চীনের অযাচিত মাতব্বরি আচরণের কারণে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একধরনের চীনবিরোধী জোট তৈরি হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও চীন একই আচরণ করেছে। ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে হুমকি বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় দ. কোরিয়া তার সীমানায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বসাল, তখন চীন তাৎক্ষণিকভাবে সিউলের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করল। এতে দ. কোরিয়ার জনমত সাংঘাতিকভাবে চীনের বিরুদ্ধে চলে গেল। অংশত জনগণের চাপে মারকোসের মতো দ. কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সাকয়েওল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করলেন এবং জাপানের সঙ্গেও সামরিক সম্পর্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিলেন।
করোনার উৎপত্তি নিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত দাবি করায় অস্ট্রেলিয়ার ওপরও চীন একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে অস্ট্রেলিয়াও চীনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘অকাস’ নামের একটি প্রতিরক্ষা জোট গড়ে তোলে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড জোট রয়েছে। এর সবই চীনের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় আরও দায়িত্বশীল হয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে অধিকতর সহনশীল আচরণ করতে হবে। নয়তো এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।