শেষ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ধর্মীয় অনুষ্ঠান মহাকুম্ভ। ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) গঙ্গা, যমুনা ও অন্তঃসলীলা সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে বুধবার শিবরাত্রির দিন শেষ অবগাহনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটতে চলেছে ৪৫ দিনব্যাপী মহাকুম্ভের। মঙ্গলবার রাত দুইটা থেকে শুরু হয় শেষ তিথির স্নান, আজ বুধবার দিনাবসানের মধ্য দিয়ে তা শেষ হতে চলেছে। শেষ দিন সঙ্গমে জড়ো হওয়া পুণ্যার্থীদের ওপর আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ফুলের পাপড়ি। এত দিন ধরে এত মানুষের উপস্থিতিতে এমন ধর্মীয় আচার ভারতে আগে কখনো হয়নি।
মহাকুম্ভ আজ শেষ হলেও ভবিষ্যতে এই আয়োজনস্থল পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন ভারতের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুক। তিনি বলেছেন, পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভে পুণ্যার্থীদের সঙ্গমে জলের পরিবর্তে বালিয়াড়িতে ডুব দিতে হবে।
এবারের মহাকুম্ভ শুরু হয়েছিল ১৩ জানুয়ারি, পৌষপূর্ণিমার পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে।
পরদিন ১৪ জানুয়ারি ছিল মকরসংক্রান্তি। তার পরের পুণ্য তিথি ছিল ২৯ জানুয়ারির মৌনী অমাবস্যা, যেদিন ঘটে যায় পদপিষ্ট হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা। ওই দুর্ঘটনাও পুণ্যার্থীদের স্রোত কমাতে পারেনি। বসন্তপঞ্চমী (৩ ফেব্রুয়ারি), মাঘীপূর্ণিমা (১২ ফেব্রুয়ারি) এবং ২৬ ফেব্রুয়ারির শিবরাত্রির দিন শাহি স্নান উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষ প্রয়াগরাজে ভিড় করেছেন। কোটিপতির সঙ্গে সাধারণ মানুষ, খ্যাতনামার পাশাপাশি অখ্যাত–অজ্ঞাত সবাই মিলেমিশে অবগাহন করেছেন সঙ্গমে। মারাত্মক জলদূষণের বিতর্কও দমাতে পারেনি পুণ্যলোভী জনতাকে। বিজ্ঞান ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বাস।
মহাকুম্ভে কোটি কোটি মানুষ এবার যেখানে ডুব দিয়েছেন, সঙ্গমের সেই এলাকার গভীরতা হাঁটুজলের বেশি নয়। আরও ১৪৪ বছর পর এবারকার মতো গ্রহ–নক্ষত্রের মহামিলন মহাতিথির জন্ম দিলে মহাকুম্ভের যে আসর বসবে, সে সময় সঙ্গমস্থলে জলের ক্ষীণ প্রবাহও থাকবে না বলে সাবধান করে দিয়েছেন লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক। আমির খানের তৈরি ‘থ্রি ইডিয়টস’–এর ‘র্যাঞ্চো’ বাস্তবের সোমন ওয়াংচুক দিল্লিতে সবাইকে সতর্ক করে মঙ্গলবার বলেছেন, লাদাখসহ গোটা হিমালয়ে উষ্ণায়ন, সেনানীদের দাপাদাপি, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিবেশের যে ক্ষতি করে চলেছে, তাতে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভে পুণ্যার্থীদের সঙ্গমে জলের পরিবর্তে বালিয়াড়িতে ডুব দিতে হবে।
পরিসংখ্যান দেখিয়ে সোনম বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে হারে ঘটছে, তাতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর অধিকাংশ হিমবাহের দৈর্ঘ্য এক–তৃতীয়াংশ কমে যাবে। হিমালয়ের হিমবাহগুলো ক্রমে পেছিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, লাদাখের নুব্রা উপত্যকায় খারদুংলা হিমবাহ পার হতে সেনাবাহিনী লোহার সেতু তৈরি করেছিল ১৯৯২ সালে। আজ সেই হিমবাহ ৫০০ মিটার পেছিয়ে গেছে। সেতুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
সরকারকে সতর্ক করে সোমন বলেছেন, হিমালয় থেকে উৎপত্তি গঙ্গা, যমুনার মতো নদীগুলো হিমবাহ–নির্ভর। হিমবাহ বাঁচানো না গেলে এসব নদী বর্ষানির্ভর হয়ে পড়বে। তেমন হলে ১৪৪ বছর পর সঙ্গমে হাঁটুজলও থাকবে না। মহাকুম্ভর আসরে মানুষকে বালুতে ডুব দিতে হবে। সোমন বলেছেন, হিমবাহ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ২০২৫ সালকে ‘হিমবাহ বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে তাঁর অনুরোধ, হিমালয়ের হিমবাহ এলাকাগুলো যাতে সব দেশ সেনাহীন অঞ্চল বা ‘নো মিলিটারি জোন’ ঘোষণা করে, সে জন্য তিনি সচেষ্ট হন। হিমবাহ রক্ষায় কমিশন গঠন করার প্রস্তাবও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রেখেছেন।
৬৫ কোটি মানুষের স্নান?
এবার মহাকুম্ভ শুরুর আগে থেকেই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছিলেন, দেশ–বিদেশের ৪০ কোটি পুণ্যার্থী সঙ্গমে ডুব দেবেন। বুধবার শেষ দিনের স্নান শুরুর আগে সরকারি ঘোষণায় জানা যায়, প্রয়াগরাজে উপস্থিত জনতার সংখ্যা ৬৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই বিশাল উদ্যাপন পুরোপুরি কুসুমকোমল না হলেও উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ অবশ্যই সাফল্যের দাবি করতে পারেন। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই নেতা এই সফল উদ্যাপনের কৃতিত্ব দাবির পাশাপাশি বুধবার বলেছেন, ‘সঙ্গমে আসা সাধু, সন্ন্যাসী ও ভক্তদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ভগবান শিব ও মা গঙ্গা সবার কল্যাণ করুন, এটাই একমাত্র কামনা।’
১২ বছর অন্তর মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হলেও এবার গ্রহ–নক্ষত্রের অবস্থান মহাকুম্ভকে অনন্য করে তুলেছে। শেষবার এমন হয়েছিল ১৪৪ বছর আগে। সেই কারণে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে এবারের মহাকুম্ভের আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকার তাই এবার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি। এত বছর ধরে মহাকুম্ভের আয়োজন হলেও এই প্রথম তা হলো উত্তর প্রদেশ ও কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আমলে। ফলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সফল হতে সতর্ক ছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যবারের মতো এবারের মহাকুম্ভও দুর্ঘটনাবর্জিত হতে পারেনি। একাধিকবার মেলায় পুণ্যার্থীদের তাঁবুতে আগুন লেগেছে। পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন বহু। সরকারি হিসাবে ৩০ জনের মৃত্যু ও ৬০ জন আহত হলেও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা অনেক বেশি। সঙ্গমমুখী যাত্রীবাহী ট্রেন আচমকা বাতিল হওয়ায় হুড়োহুড়িতে দিল্লির স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন ১৮ জন। আহত শতাধিক। সঙ্গমের পথে ঘটে গেছে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনাও। তাতেও হতাহতের সংখ্যা নগণ্য নয়।
প্রয়াগরাজমুখী সড়কগুলোয় দেখা গেছে অভূতপূর্ব যানজট। এমনও হয়েছে, প্রয়াগরাজের ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে যানবাহনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, এক শহরে ৪৫ দিন ধরে ৬৫ কোটি মানুষের জমায়েত নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই কৃতিত্বের। দল হিসেবে বিজেপি এবং ব্যক্তি হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ ও তাঁর প্রশাসন সেই সাফল্যের দাবিদার।