আফ্রিকান ফুটবলে মরক্কো বড় দল। আঞ্চলিক শিরোপা আছে। ওই অঞ্চল থেকে ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ খেলাও কম নয়। তবে বিশ্বমঞ্চে তাদের আগমণ ছিল ছোট দল হিসেবেই। কাতারেও পিঠে ‘ছোট দল’ তকমা নিয়ে এসেছিল তারা। যদিও দলটির অধিকাংশ ফুটবলার ইউরোপের লিগে খেলেন। যাদের ভালো করার স্বপ্ন ও সামর্থ্য ছিল। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের বিবেচনায় ঠিক ‘নায়ক’ ছিলেন না কেউ। ছিলেন ‘উপনায়ক বা পার্শ্বনায়কের’ চরিত্রে। তবে এখন তারা ইতিহাস গড়ার কারিগর। আফ্রিকান ফুটবলের নায়ক।
ইউরোপের লিগ নিয়ে যারা মেতে থাকেন তাদের জন্যও বিশ্বকাপের আগে মরক্কোর খুব বেশি খেলোয়াড়ের নাম বলা কঠিন ছিল। অনেকেই দলটির সেরা তারকা বলতে আশরাফ হাকিমির কথা বলবেন। অথচ তিনি খেলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। সেভিয়ায় খেলার সুবাদে ইয়াসেন বোনোর নাম হয়তো অনেকেই জানতেন। কিন্তু তিনি যে মরক্কোর তা আগ বাড়িয়ে জানার সময় ক’জনের ছিল! হাকিম জায়েখ তো মরক্কোয় খেলা চালিয়ে যাবেন নাকি নেদারল্যান্ডসে যাবেন ওই দ্বন্দ্বে অবসরও নিয়েছিলেন।
অথচ দলটির প্রায় সকলেই খেলেন ইউরোপের শীর্ষ লিগে। যেমন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার জাওয়াদ ইয়াকিম খেলেন রিয়াল ভায়াদোলিদে, রোমান সেইস খেলেন বেসিকটাসে। মিডফিল্ডার সোফান আম্রাবাত ইতালির ক্লাব ফিওরেন্টিনায় খেলেন। মিডফিল্ডার আজেদিন ওউনাহি ফ্রান্সের লিগে এবং সেলিম আমাল্লাহ বেলজিয়ামের লিগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আক্রমণভাগের জায়েখ চেলসিতে, ইউসেফা নাসরি সেভিয়া ও সোফিয়ান বউফল খেলেন ফ্রান্সের এঞ্জার্সে।
তাদের বেঞ্চও একেবারে খারাপ নয়। তরুণ নাম্বার টেন আনাস জারোউরি যেমন বার্নলিতে খেলেন। আব্দেল হামিদ সাবেরি খেলেন ইতালির সাম্পাদোরিয়ায়, ফরোয়ার্ড জাকারিয়া আবুলখালাল ফ্রান্সের তুলুজের জার্সি পরেন। আব্দে এজালজৌলি খেলেন স্পেনের ওসাশুনায়। আশরাফ দারি খেলেন ফ্রান্সের ব্রেস্তে। তাদের সকলকেই ‘পার্শ্বনায়ক’ বলতে হবে। কারণ বড় ক্লাবের বড় নাম নন তারা। ছোট কিংবা মাঝারি ক্লাবের ‘মাঝারি তারকা’ হওয়ায় কষ্ট করে তাদের নাম নিজ ক্লাব, দেশ কিংবা প্রতিবেশি দলের ভক্তরা ছাড়া মনে রাখেন ক’জন?
কিন্তু তারা সামর্থ্যবান। চেলসিতে হাকিম জায়েখ দুর্দান্ত কাউন্টার অ্যাটাক ও সেট পিস থেকে প্রতিপক্ষ শিবিরে ভয় ধরাচ্ছেন। পিএসজির আশরাফ হাকিমি রক্ষণের সঙ্গে কাউন্টার অ্যাটাকের বিল্ড আপ করে দিচ্ছেন। সেভিয়ার গোলরক্ষক বোনো গ্লাভস হাতে আস্থার প্রতীক। কোন গোল খাননি তিনি এখনও। স্ট্রাইকার ইউসেফা এন নাসরি তো পর্তুগালের বিপক্ষে গোল করে নায়ক হয়ে গেছেন।
কাতার বিশ্বকাপ তাদের জন্য খ্যাতির দরজা খুলে দিয়েছে। অথচ কঠিন এক গ্রুপ পার হয়ে নকআউটে আসতে হয়েছে তাদের। ক্রোয়েশিয়াকে রুখে, বেলজিয়ামকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলোর টিকিট কেটেছে। প্রথমে প্রতিবেশি স্পেন এবং পরে পর্তুগালকে বিদায় করেছে। এবার আরেক প্রতিবেশি ফ্রান্সের বিপক্ষে জাত চেনানোর পালা তাদের।
মরক্কো প্রথম বিশ্বকাপ খেলে ১৯৭০ সালে। ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার ১৪ বছর পরে। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে অপেক্ষা করতে হয় ১৬ বছর। ওই আসরে ইংল্যান্ড ও পোল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপে গোলশূন্যর পর পর্তুগালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নকআউটে পা রাখে। ওটাই এতোদিন ছিল তাদের সেরা সাফল্য। অন্য চার আসরে গ্রুপের ‘চৌকাঠ’ পেরোতে পারেনি দ্য আটলাস লায়ন্সরা। বিশ্বকাপে আগের ১৬ ম্যাচ জয় ছিল মাত্র দুটি। ওই রেকর্ড এবারের আসরে ছাড়িয়ে গেছে তারা। অপেক্ষা কেবল ইতিহাসের পাতা কতদূর এগোয় তা দেখার।