দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে ফি সমন্বয় করতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং ডেন্টাল কলেজের আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এমবিবিএস ও বিডিএসে ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী ভর্তিতে বাড়তি তিন লাখ টাকার বেশি গুনতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষ করতে খরচ হবে প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ। হঠাৎ ভর্তি ফি বৃদ্ধিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থে বাড়ানো হয়েছে মেডিকেলে ভর্তি ফি। অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নিয়ম-নীতিহীনভাবে এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ডাক্তারি পড়ার সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। এদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সব মহলের সঙ্গে আলোচনা করে সহনশীল পর্যায়ে রেখে বাড়ানো হয়েছে মেডিকেলে ভর্তি ফি। তবে অভিভাবকরা বলছেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি। এই সময়ে হঠাৎ ফি বাড়ানো যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মেডিকেলে শিক্ষা ব্যয়কে আকাশচুম্বী দেখছেন অভিভাবকরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ও বিডিএসে ভর্তি ফি বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এ বৈঠকে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও মালিকপক্ষ থেকে সব মিলিয়ে ভর্তি ফি ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। টানা দুই ঘণ্টা বৈঠকে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে ১৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা ধার্য করা হয়, যা বর্তমান ফির চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ মার্চে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এত দিন এ ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে ইন্টার্নশিপ ফি এক লাখ ৮০ হাজার এবং টিউশন ফি ১০ হাজার টাকা করে চার বছরে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা আগের শিক্ষাবর্ষের মতো বহাল রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, কোনো প্রকার নীতিমালা ছাড়াই হঠাৎ মেডিকেলে ফি বৃদ্ধি মেডিকেল শিক্ষায় নীতিবাচক প্রভাব ফেণবে। সব শিক্ষার্থী সরকারি মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাবে না। মেডিকেলে ভর্তি ফি বৃদ্ধির একটি নীতিমালা তৈরির পক্ষে মত দেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারিতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের থেকে যে মুনাফা হয়, তাতেও অনেকাংশে চাহিদা পূরণ হওয়ার কথা। খরচ বাড়ায় বেসরকারিতে পড়া অধিকাংশই হবে ধনী শ্রেণির সন্তান, কর্মজীবনে যারা প্রান্তিক অঞ্চলে সেবা দেওয়ার মানসিকতা রাখবে না।
ভর্তি ফি বাড়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন মেডিকেলে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাদিয়া জান্নাত প্রত্যাশা। রাজধানীর ফামর্গেটে একটি কোচিং সেন্টারে ক্লাস করছেন। প্রত্যাশা বলেন, হঠাৎ এমন ফি বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকারি মেডিকেলে চান্স না পেলে বেসরকারিতে পড়তে হবে। তবে ফি বৃদ্ধিতে আমাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের পড়া হবে কষ্টসাধ্য। বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি ফি বৃদ্ধিতে কপালে ভাঁজ পড়েছে তাঁর বাবা সাজেদুল ইসলাম সরকারের। তিনি বলেন, গত ৬ মাসে কয়েক দফায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে মেডিকেলে ভর্তি ফি বৃদ্ধি নতুন সংকট তৈরি করবে। মেয়ে সরকারি মেডিকেলে চান্স না পেলে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ানো সম্ভব হবে কিনা- এ নিয়ে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি ফি বাড়ানো বা কমানোর এখতিয়ার বিএমডিসির নেই। এটি সমন্বয় করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সবার আগে প্রাইভেটাইজেশন অব মেডিকেল এডুকেশন কোয়ালিটি কন্ট্রোল তথা চিকিৎসা শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। মেডিকেলে ভর্তি ফি বাড়ানোর সঙ্গে শিক্ষাদানের গুণগত মান বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. টিটো মিয়া বলেন, সবার সঙ্গে সমন্বয় করে মেডিকেলে ফি নির্ধারণ চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে আর বাড়ানো বা কমানোর সম্ভাবনা নেই। দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে মেডিকেলে ভর্তি ফি সমন্বয় করে এটি করা হয়েছে। হঠাৎ ফি বৃদ্ধিতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত বা তাঁদের ডাক্তারি পড়ার সুযোগ সংকুচিত হবে কি- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফি বৃদ্ধি সহনশীল পর্যায়ে রাখা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তবে এ সেশনের শিক্ষার্থী ভর্তি শেষ হলে প্রভাব কেমন পড়বে, বোঝা যাবে।
বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুবিন খান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ ফি দেড় কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় ৮০ লাখ, ভুটানে ৫৫ লাখ, নেপালে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিবেশী দেশের বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি ফি দেখে এ ফি সমন্বয় করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে মেডিকেলে ভর্তি ফি বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়। পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটা চূড়ান্ত হয়ে গেছে।