আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সংসদে আরপিওর সংশোধনী প্রস্তাব তোলার পর তীব্র আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম–বলপ্রয়োগের মতো ঘটনা ঘটলে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সীমিত হচ্ছে। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা কমিয়ে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাব গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে তোলা হয়েছে।
বর্তমান আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি মনে করে তারা আইনানুগ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে ইসি। এখন এই ক্ষমতা সীমিত করে ইসিকে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের (অনিয়মের কারণে) ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
আরপিওর সংশোধনী প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করে ফেলার পর কোনো আসনের পুরো ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফল বাতিল করে কোনো সংসদীয় আসনে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে ইসি। এসব বিধান রেখে আরপিও সংশোধনী বিল গতকাল জাতীয় সংসদে তুলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আইনের এই সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ এনে বিলটি উত্থাপনে তীব্র আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তবে তাঁর আপত্তি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তাঁর বক্তব্যের পাল্টায় আইনমন্ত্রী দাবি করেন, আরপিওতে সংশোধনী জনগণের কোনো অধিকার খর্ব করে না। এটা শূন্য ভাগও গণতন্ত্র ব্যাহত করে না।
পরে আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে তোলেন। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৫ দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দিতে আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন আভাস দিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারি মাসের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হবে। এর আগে আরপিওতে যে সংশোধনী আনা হচ্ছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
এই ধারার ব্যাখ্যায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এত দিন বলে আসছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা পর্যন্ত যেকোনো সময় ইসি ভোট বন্ধ এবং ফলাফল বাতিল করতে পারে।
তবে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধারায় ৯১(এ) অস্পষ্টতা আছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর তা ইসির কাছে পাঠানো হয়। ইসি সচিবালয় গেজেট প্রকাশ করে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা করার পর গেজেট প্রকাশ না করে ইসি ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ইসি এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা প্রস্তাবে বলেছিল, কোনো অনিয়ম, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করতে পারবে।
তবে ইসিকে পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। সংসদে আরপিওর যে সংশোধনী তোলা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, যেসব ভোটকেন্দ্রে (এক বা একাধিক) এসব অভিযোগ থাকবে, ইসি শুধু সেসব কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন নির্বাচন করতে পারবে।
সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। এই সংশোধনী পাস হলে নির্বাচন কমিশন অনিয়মের কারণে শুধু ভোটের দিন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। তাই এখানে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। তবে আইনে ‘ইলেকশন’ শব্দটির সংজ্ঞাও পরিষ্কার নয়।
অবশ্য ইসির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এত দিন আইনের এই ধারায় অস্পষ্টতা ছিল। এখন কোন কোন ক্ষেত্রে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।
ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে
বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ৫২ বছর পর হলেও নির্বাচন কমিশন (গঠন) আইন করেছি। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবে। আমরা আইন করতে যাচ্ছি। আইন করে যদি স্বাধীনতাটাকে ক্যানসেল (খর্ব) করে দিই, তাহলে কমিশন কীভাবে স্বাধীন থাকবে?’
ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গাইবান্ধার নির্বাচন খারাপ হয়েছিল বলে কমিশন বন্ধ করে দিয়েছে। জানি না কী কারণে আইনমন্ত্রী আবার এখন আনলেন (আরপিও সংশোধনী) নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, গাইবান্ধার মতো পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচন কমিশনের কাছে আর থাকছে না। তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি সংবিধানের চেতনা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোট ছিল। ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ভোট গ্রহণ চলার একপর্যায়ে সেখানে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয় ইসি।
এদিকে গতকাল সংসদে ফখরুল ইমামের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই সংশোধনী সংবিধান বা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়। আইনের ৯১ (এ) ধারায় বলা আছে, কোনো নির্বাচনী এলাকায় সমস্যা, গন্ডগোল, ভোট দিতে বাধা দিলে পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন ইসি বন্ধ করে দিতে পারে।
আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে সংশোধনী হলো কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল হলে সেখানে ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু দু–তিনটি ভোটকেন্দ্রের গন্ডগোলের কারণে অন্য যে কেন্দ্রগুলোতে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, সেগুলোর নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়। কারণ, যেখানে সঠিকভাবে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে গণতান্ত্রিকভাবে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। সেটা নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারবে না। যদি বন্ধ করতে পারত, সেটা অগণতান্ত্রিক হতো।
এ ছাড়া সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে তাঁকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
‘নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারা’
আরপিওতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তা জাতীয় সংসদে পাস হলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হবে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। গত রাতে তিনি বলেন, নির্বাচনের তিনটি পর্যায়। এর একটি হলো ‘পোলিং’। পোলিং অর্থ, ভোটের দিন বোঝায়। আর তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়কে ‘ইলেকশন’ বোঝায়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘যদি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) অনুচ্ছেদে “ইলেকশন” শব্দের বদলে “পোলিং” শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে ইসি শুধু ভোটের দিন ভোট বন্ধ করতে পারবে। আর “ইলেকশন” শব্দ থাকলে যেকোনো পর্যায়ে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন যদি নিজেরা এই সংশোধনীর প্রস্তাব করে থাকে বা নিজেরা এর সঙ্গে সম্মত হয়ে থাকে, তাহলে তারা নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারল।’