বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুন এলেই যশোরের ঝিকরগাছার গোলাপচাষিদের মুখে চওড়া হাসি ফোটে। কিন্তু এবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ, ভালোবাসা দিবসের আগমুহূর্তে এসে দরপতন ঘটছে ফুলের বাজারে।
ঝিকরগাছার গদখালী দেশের অন্যতম পাইকারি ফুলের বাজার হিসেবে পরিচিত। ফুলচাষিরা বলছেন, গতকাল রোববার গদখালীতে ভালো মানের প্রতিটি গোলাপ পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকায়। আজ সোমবার সকালেও মানভেদে গোলাপ বিক্রি হয়েছে ১৮ থেকে ২৫ টাকায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই গোলাপের দাম নেমেছে ১২ থেকে ১৬ টাকায়। ভারত থেকে আসা ফুলের কারণে এবার বাজারে দরপতন ঘটেছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি ও তীব্র শীতের কারণে উৎপাদন কমায় চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশেই গদখালী বাজার। আজ সকালে গদখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ও ভ্যানে গোলাপ ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন কয়েক শ চাষি। দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা দরদাম করে ওই গোলাপ কিনছেন।
ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কাকডাকা ভোর থেকে শুরু হয় ফুল কেনাবেচা। সকাল ৮টা পর্যন্ত গোলাপের দাম প্রতিটি ১৮ থেকে ২২ টাকা দরে বিক্রি হয়। আটটার পর থেকে দাম পড়তে শুরু করে। এরপর ১২ থেকে ১৬ টাকা দরে বিক্রি হয়।
দাম পড়তে শুরু করলে কৃষকের মধ্যে অস্বস্থি বাড়তে থাকে। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন চাষিরা। একপর্যায়ে তারা সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অবশ্য ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা একমত হতে না পারায় শেষ পর্যন্ত মানববন্ধন হয়নি।
বাজারে ভারতীয় গোলাপের প্রভাব
গোলাপচাষিরা অভিযোগ করেন, আজ সকালে কয়েক ব্যক্তি গদখালীর বাজারে ভারতের গোলাপ নিয়ে আসেন। চট্টগ্রামসহ বাইরের ব্যাপারীরা কম দামে ওই গোলাপ কিনে নেন। ফলে চাষিদের গোলাপের দাম নিম্নমুখী হয়। সাধারণত গদখালী বাজারে সকাল ৯টার মধ্যে ফুল বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আজ সকাল সাড়ে ১০টার পরেও বেচাকেনা হতে দেখা গেছে। বিক্রি না হওয়ায় অনেক চাষি ফুল বিক্রি না করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।
৮০০টি গোলাপ নিয়ে বাজারে এসেছিলেন ঝিকরগাছার হাড়িয়া গ্রামের চাষি নয়ন হোসেন। তিনি গতকাল প্রতিটি গোলাপ ২৫ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। নয়ন বলেন, ‘আজ ১৫ টাকার ওপরে ব্যাপারীরা দাম বলছেন না। অথচ ভালোবাসা দিবসের আগে আজ দাম আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। ভালো দাম না পাওয়ায় গোলাপ বিক্রি না করে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছি।’
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত স্থলবন্দর দিয়ে ১ হাজার ৫৫ কেজি গোলাপ আমদানি করা হয়েছে। প্রতি কেজি গোলাপের আমদানিমূল্য ছিল দুই ডলার।
উপজেলার পটুয়াপাড়া গ্রামের গোলাপচাষি মো. লাল্টু বলেন, ‘এলসির মাধ্যমে ভারত থেকে গোলাপ আসার কারণে চাষিদের গোলাপ মার খেয়েছে। ভালোবাসা দিবসের এক দিন আগে যেখানে গোলাপের দাম বেশি হওয়ার কথা, সেখানে কমে গেছে। যে কারণে ৭০০ গোপাল বিক্রি না করে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল ওই গোলাপ আবার হাটে নিয়ে আসব। দেখা যাক, কী হয়।’
একই অভিযোগ করে যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, অনেকে সীমান্তের চোরাই পথে ও এলসি খুলে ভারত থেকে গোলাপ এনেছেন। এতে হাঠাৎ করে গোলাপের দাম পড়ে গেছে। গতকাল যেখানে ২৫ টাকা দরে ফুল বিক্রি হয়েছে, সেখানে আজ দাম না বাড়লেও স্থিতিশীল তো থাকবে। অথচ দাম পড়ে গেছে। এতে গোলাপচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
আবদুর রহিম বলেন, ‘ফুল তো আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। তাহলে বিদেশ থেকে ফুল আমদানি করার তো দরকার নেই। ফুল আমদানি হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁরা ফুল উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। আমরা ফুল আমদানি বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।’
গদখালীতে সকাল সকাল ফুল কিনে ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানালেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার ফুল ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ভালোবাসা দিবসে বিক্রির জন্য সকাল আটটার আগে ১৬ থেকে ২৪ টাকা দরে প্রতিটা গোলাপ কিনেছেন। ১ হাজার ২০০ গোলাপ, প্রতিটি ৮ থেকে ১১ টাকা দরে ১ হাজার গ্লাডিওলাস ও ১২ টাকা দরে ৫০০ রজনীগন্ধা ফুল কিনেছেন। পরে দেখলেন, গোলাপের দাম পড়ে গেছে। এতে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঝিকরগাছায় এবার ১৫০ হেক্টর জমিতে অন্তত আড়াই হাজার কৃষক গোলাপ ফুলের চাষ করছেন। তবে ভারত থেকে গোলাপ আমদানির বিষয় জানা নেই বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন।
বিরূপ আবহাওয়ায় উৎপাদনে ধাক্কা
জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বৃষ্টি ও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়ায় গোলাপ খেতে ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দেয়। এতে গোলাপ গাছের পাতা ঝরে যায়। কুঁড়ি পচে যায়। ফলে এবার উৎপাদন কমেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।
হাড়িয়া গ্রামের আবদুল মান্নান বলেন, এক বিঘা জমিতে (৩৩ শতক) গোলাপ চাষ করেছেন। গত বছর এই সময়ে খেত থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার গোলাপ কেটেছের। খেতে পচা রোগের কারণে এবার সেখানে দুই থেকে তিন হাজার গোলাপ কেটেছেন। তবে কয়েক দিন ধরে তুলনামূলক দাম ভালো পাওয়ায় ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে গেছে।
হাড়িয়া গ্রামের রুবেল হোসেন বলেন, ৭৪ শতক জমিতে গোলাপের চাষ রয়েছে। ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হঠাৎ তীব্র শীত ও কুয়াশায় গোলাপ বাগানে ভাইরাস লেগে। এতে উৎপাদন কমে গেছে। সার-কীটনাশকের দোকানে অনেক টাকা ঋণ রয়েছে। দাম কমায় এখন ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেবেন বুঝতে পারছেন না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, অসময়ে বৃষ্টি ও তীব্র ঠান্ডায় গোলাপ খেতে ছত্রাকজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে ডাচ ও চায়না জাতের গোলাপ বাগানে ক্ষতি হয়। পরে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া সেই রোগ এখন আর নেই। তবে ওই রোগে গোলাপচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।