সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্রোকার ও ডিলার প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ তলানিতে। ডিএসইতে লেনদেন এখন মাঝে মাঝে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তারও নিচে নেমে আসছে, যার অন্যতম কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ কমে যাওয়া। কেন প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে না, সে বিষয়ে সম্প্রতি লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চিঠি দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা জানান, শুধু লিখিত ব্যাখ্যা নয়; সরাসরি কমিশন কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। তারা বলেছেন, ফ্লোর প্রাইসই এ বাজারের নানামুখী সংকট তৈরি করছে। ফ্লোর প্রাইস না উঠলে এ সমস্যার সহসা সমাধান নেই বলে মনে করেন তারা।
তারা আরও জানান, ব্রোকার ও ডিলার প্রতিষ্ঠানগুলো কেন বিনিয়োগ করছে না বা করতে পারছে না, তার সবটাই কমিশন জানে। তারপরও এমন চিঠি হয়রানি ছাড়া কিছু নয়। কমিশন হয়তো মনে করছে, এভাবে চিঠি দিলেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়বে।
বিএসইসির কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, হয়রানি নয়; শেয়ারবাজারের লেনদেন কমার কারণ বুঝতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মতামত চাওয়া হয়েছে। যদি এমন কোনো সমস্যা উদ্ভূত হয়ে থাকে, যার সমাধান সম্ভব, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
বিনিয়োগ করতে না পারার কী ব্যাখ্যা কমিশনকে দিয়েছেন– এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের সিইও বলেন, প্রথমত নতুন করে বিনিয়োগ করার কোনো টাকা তাদের নেই। আগের সিংহভাগ বিনিয়োগ ফ্লোর প্রাইসের কারণে আটকে গেছে। আগের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার সুযোগ না পেলে নতুন করে বিনিয়োগ করার পরিস্থিতি নেই। অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগও কমে গেছে। এতে ব্রোকারেজ কমিশনের আয়ও ব্যাপকভাবে কমেছে। বর্তমান আয় দিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা ও পরিচালন খরচ মেটানো দায়।
প্রকৃতপক্ষে শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে– এমন মন্তব্য অপর এক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের এমডির। তিনি জানান, বড় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রায় সবাই ঋণ করে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়েছে। সিংহভাগ শেয়ারের ক্রেতা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় ঋণের অর্থও ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের ঠিকই ব্যাংক ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তারা জানান, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে চলছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা নেই। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ার কারণে কেউ শেয়ার কিনছে না। এখন শেয়ার কেনাবেচা না হলে ব্রোকারেজ হাউস কোথা থেকে আয় করবে আর নতুন করে বিনিয়োগ কীভাবে করবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কর্মকর্তারা এখনও মনে করছেন, ফ্লোর প্রাইস ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দিচ্ছে। ফ্লোর প্রাইস না থাকলে দরপতন হলে অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যেতেন বলেও মনে করেন তারা। ব্রোকারদের ব্যাখ্যা বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, ব্রোকাররা ফ্লোর প্রাইসের কারণে লেনদেন হ্রাসকে বিনিয়োগ না করার কারণ হিসেবে মত দিয়েছেন। তারা ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের কথাও বলেছেন।
ব্রোকারদের এভাবে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কমিশন নিজেই এ বাজারের সমস্যা তৈরি করেছে। এ বাজারকে পঙ্গু করে রেখেছে। এখন কেন সমস্যা হয়েছে জানতে চাওয়া তামাশা ছাড়া কিছু নয়।
বাজার সংক্ষেপ: গতকাল ডিএসইর লেনদেন প্রায় দেড় মাস পর ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কেনাবেচা হয়েছে ৭৩৪ কোটি টাকার শেয়ার। এর আগে গত ২৩ জুলাই ডিএসইতে ৭০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল।
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইর লেনদেন ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে; কেনাবেচা হয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শেয়ার। ব্লক মার্কেটে ইসলামী ব্যাংকের ৫২৫ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনই এ বাজারে এত বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। স্বাভাবিক দিনে সিএসইতে ৫ থেকে ১৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়।
ডিএসইতে ৮৯ শেয়ারের দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৬৮টির দর কমেছে এবং অপরিবর্তিত ছিল ১৮৩টির দর। ক্রেতার অভাবে ৫২ শেয়ারের কোনো লেনদেন হয়নি। তবে সোমবারের তুলনায় ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা শেয়ার সংখ্যা তিনটি কমে ২২৩টিতে নেমেছে।