রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা গত বছর ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ অন্তত ২৩টি দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ব্রিকসকে পুরোপুরি একটি পশ্চিমাবিরোধী ফোরামে রূপান্তরে আগ্রহী নয় ভারত ও ব্রাজিল।
নতুন কোনো দেশকে যুক্ত করার বিষয়ে জোটের সদস্যদের দ্বিধা-বিভক্তির কারণে আগামী সপ্তাহে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এর পরিধি বাড়ছে না। তাই জোটে যোগ দিতে গেলে আপাতত অপেক্ষায় থাকতে হবে বাংলাদেশসহ আগ্রহী দেশগুলোকে।
ব্রিকস হচ্ছে পাঁচ দেশের একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট। মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—সদস্য এই পাঁচ দেশের আদ্যক্ষর অনুযায়ী ব্রিকসের নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ব্রিকসের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
রাজি নয় ভারত ও ব্রাজিল
ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে চীনের আগ্রহটাই ছিল বেশি। বিশেষ করে এটিকে পশ্চিমাবিরোধী প্ল্যাটফর্মে রূপ দিতে চীনের আকাঙ্ক্ষাটা অজানা নয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে চীন ও রাশিয়া রাজি থাকলেও ভারত ও ব্রাজিল তাতে রাজি নয়। ভারত অবশ্য বলেছে, জোটে নতুন সদস্য নেওয়ার আগে ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর মূলনীতি চূড়ান্ত করাটা জরুরি।
সরাসরি না বললেও এবারের ব্রিকস সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাও প্রকারান্তরে ভারত ও ব্রাজিলের পথেই রয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে ব্রিকসের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার কারণে এর পরিধি এবার বাড়ছে না।
অপেক্ষায় বাংলাদেশসহ ২৩ দেশ
ঢাকা এবং প্রিটোরিয়ার কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ২২ থেকে ২৪ আগস্ট জোহানেসবার্গে ব্রিকসের পঞ্চদশ শীর্ষ সম্মেলনে নতুন সদস্য যুক্ত করার বিষয়ে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হবে না। কারণ, শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে এমন কোনো বিষয় নেই। পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোটে ভবিষ্যতে নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানানোর বিষয়টি শীর্ষ সম্মেলনের আলোচনায় আসবে।
বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেওয়ার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। ২০২১ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে পরিচিত ব্রিকসের ব্যাংকে যুক্ত হয়। তবে গত জুনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ আগস্টে ব্রিকসের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। তবে ওই বৈঠকের পর, অর্থাৎ জুন মাসে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে।
এখন পর্যন্ত ব্রিকসে যোগ দিতে ২৩টি দেশ আবেদন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ আবেদন করেছে ২০২৩ সালে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, গত জুনে জেনেভায় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ব্রিকসে যাওয়ার জন্য। তখন ধারণা ছিল, তারা নতুন কিছু দেশকে ব্রিকসের সদস্য করবে।
তবে এটা ব্রিকসের সদস্য পাঁচ দেশের ওপর নির্ভর করে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সেখানে যে বিতর্ক (ডিবেট) হচ্ছে, সেটি হচ্ছে—তিনটি দেশ চাইছে নতুন সদস্য নেবে। এ ছাড়া ভারত ও ব্রাজিল বলছে, নেওয়ার আগে নতুন নিয়মকানুন তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট তখন বলেছিলেন, তাঁরা চারটি দেশকে নিতে চান। আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কারা কারা? তখন তিনি জানিয়েছিলেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ।’
ভারতের বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক হর্ষ পন্ত এক নিবন্ধে লিখেছেন, চীন সমমনা দেশগুলোকে ব্রিকসে স্বাগত জানানোর কথা বললেও ভারতের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে সতর্ক।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যখন মন্তব্য করেন, জোটের পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে এখনো কাজ হচ্ছে। এই মন্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট যে পাঁচ দেশের জোটের কলেবর বাড়াতে সদস্যদেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। তাই সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বিষয়টি পারস্পরিক আস্থা ছাড়া জোটের কলেবর বৃদ্ধির প্রয়াস বিফলে যাবে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক আজ বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, ব্রিকসের মতো জোটে নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ফলে হুট করেই যেকোনো একটি দেশ ব্রিকসের সদস্য হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে মূলত পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের বিপরীতে বিকল্প হিসেবে জোটের যাত্রা হলেও ব্রিকসকে ব্যবহার করে পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতিতে চীনের প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে। কিন্তু ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সেটা করতে দিতে চাইছে না। ব্রিকসের সম্প্রসারণের বিষয়টি এখন আর অর্থনীতি বা উন্নয়নে সীমিত নেই, এতে বৈশ্বিক রাজনীতি যুক্ত হয়ে গেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে নতুন সদস্য যুক্ত করে জোটের কলেবর বাড়ানোর বিষয়টিকে সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিকস যেমন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করবে, পাশাপাশি জোটের সদস্যদেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার ঝুঁকিও আছে। তাই ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আগে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সহযোগিতার শর্তগুলো সতর্কভাবে মূল্যায়ন করাটা জরুরি।
ব্রিকসে যোগ দিয়ে অর্থনৈতিক সুফল নিশ্চিত করতে হলে দর-কষাকষিতে দক্ষতার পাশাপাশি জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়গুলোকে সামাল দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য থাকতে হবে। কাজেই ব্রিকসে যোগ নিজের প্রস্তুতি যথাযথ হয়েছে কি না, সেটা বাংলাদেশকে ঠিক করেই এগোতে হবে।
এর পাশাপাশি ব্রিকসের সদস্য পাঁচটি দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারও আলাদা। ব্রিকসের সদস্য পাঁচ দেশের এসব অগ্রাধিকারের বিষয়টিকেও বাংলাদেশকে বিবেচনায় নিতে হবে।