খেলোয়াড় ও কোচের ভূমিকায় ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন তিনি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কিংবদন্তি মর্যাদা পাওয়া সেই মারিও জাগালো ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাঁর অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে বিবৃতির মাধ্যমে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অনেক দুঃখের সঙ্গে আমরা চারবার বিশ্বকাপজয়ী মারিও হোর্হে লোবো জাগালোর মৃত্যুর খবর জানাচ্ছি।’ তাঁর মৃত্যুতে ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ) ৭দিনের শোক ঘোষণা করেছে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের সেই দলটির জীবিত একমাত্র সদস্য হিসেবে এত দিন বেঁচে ছিলেন জাগালো। ফুটবল-বিশ্বে ব্রাজিলের বড় শক্তি হিসেবে উঠে আসার পথে অবিস্মরণীয় ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৫৮ সালে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে ৮ বছর আগের সেই ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’ মাটিচাপা দিয়েছিল ব্রাজিল।
বেঁচে থাকতে জাগালো মারাকানা ‘দুঃখগাথা’ নিয়ে বলেছিলেন, ‘উরুগুয়ের কাছে সেই দুর্ভাগ্যজনক হারে আমি মারাকানায় ছিলাম। আমি ছিলাম সৈন্যের ভূমিকায়, লোকজনকে মাঠে ঢুকতে না দেওয়া ছিল আমার দায়িত্ব। সেই হারের নিস্তব্ধতা, দুঃখ ও হতাশা আমি কখনো ভুলতে পারব না।’
ব্রাজিল দলে জাগালোর কিংবদন্তি সতীর্থ পেলে গত বছর ডিসেম্বরে পরলোকগমন করেন।
জাগালোর মৃত্যুতে সিবিএফের শোকবার্তায় সভাপতি এদনালদো রদ্রিগেজ বলেছেন, ‘অন্যতম সেরা কিংবদন্তি মারিও হোর্হে লোবো জাগালোর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত ব্রাজিল ফুটবল ফুটবল ও সিবিএফ। এই দুঃখের মুহূর্তে জাগালোর পরিবার ও ভক্তদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে সিবিএফ…এই চিরকালীন চ্যাম্পিয়ন এবং তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৭দিনের শোক ঘোষণা করছে সিবিএফ।’
ব্রাজিল যে পাঁচটি বিশ্বকাপ , তার মধ্যে চারটি শিরোপাই জাগালোর স্পর্শধন্য। অপেশাদার ফুটবল থেকে পঞ্চাশের দশকে উঠে আসা সাবেক এই লেফট উইঙ্গার ব্রাজিলের আক্রমণভাগে সৌন্দর্যের সঙ্গে রক্ষণাত্মক কলাকৌশলও যোগ করেছিলেন। বোটাফোগো ও ফ্লামেঙ্গোর হয়ে মোট পাঁচবার রিও ডি জেনিরো স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপজয়ী জাগালোর ব্রাজিল দলে অভিষেক ২৬ বছর বয়সে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ শুরুর কিছুদিন আগে জাতীয় দলে অভিষেক হয়। তবে এর পর থেকেই জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন। ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ৩৭ ম্যাচ।
’৫৮ বিশ্বকাপকে বলা হয় পেলের উত্থানের টুর্নামেন্ট। কথাটা যেমন সঠিক, তেমনি জাগালোর অবদানও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সুইডেনের বিপক্ষে ফাইনাল ৫-২ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। ফাইনালে নিজে ব্রাজিলের হয়ে চতুর্থ গোলটি করার পাশাপাশি পেলেকেও একটি গোল বানিয়ে দিয়েছিলেন জাগালো। ৪ বছর পর ’৬২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে প্রতিটি মিনিট মাঠে ছিলেন তিনি। সে বিশ্বকাপও গারিঞ্চার প্রায় একক নৈপুণ্যে জিতেছিল ব্রাজিল। ১৯৬৫ সালে অবসর নেওয়ার পর বোটাফোগো কোচের দায়িত্ব নেন। ব্রাজিল তখন সামরিক শাসনের অধীন। এর মধ্যেই বোটাফোগোকে দুবার স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতান।
’৭০ বিশ্বকাপে কোচ হিসেবে ব্রাজিলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল হোয়াও সালদানার। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগে তাঁকে সরে যেতে হয়। পেলের সঙ্গে ঝামেলা এবং স্কোয়াড নির্বাচনে তখনকার ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট এমিলিও গারাস্তাজু মেদিচির হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি সালদানা। এসব ঝামেলার কারণে ছাঁটাই হওয়ার পর ব্রাজিলের কোচ পদে তাঁর জায়গায় বসেন ৩৮ বছর বয়সী জাগালো। পেলে, রিভেলিনো, তোস্তাও, জর্জিনিও, কার্লোস আলবার্তোদের নিয়ে গড়া সর্বকালের অন্যতম সেরা সেই ব্রাজিলকে তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন কোচ জাগালো। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘কোচ হিসেবে সেটাই আমার সেরা স্মৃতি।’
’৭০ বিশ্বকাপ জয়ের পর ফ্লামেঙ্গো ও ফ্লুমিনিন্সে কোচ হিসেবে একাধিক শিরোপা জিতেছেন জাগালো। এরপর কুয়েতের ফুটবলে গিয়ে ১৯৭৬ সালে জিতেছেন গালফ কাপ। সে বছর উঠেছিলেন এশিয়ান কাপের ফাইনালেও।
১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ব্রাজিল জাতীয় দলের টেকনিক্যাল পরিচালক হিসেবে ডাক পড়ে জাগালোর। কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার সঙ্গে জুটি বেঁধে সেবার ব্রাজিলের চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ে দারুণ অবদান ছিল জাগালোর। ফাইনালে ইতালিকে টাইব্রেকারে হারিয়েছিল ব্রাজিল। ৪ বছর পর ব্রাজিল কোচ হিসেবে ফ্রান্স বিশ্বকাপে গিয়ে অবশ্য ফাইনালে হতাশ হতে হয়। ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে ফাইনাল হেরেছিল ব্রাজিল। লুই ফেলিপে স্কলারি ব্রাজিলকে ২০০২ বিশ্বকাপ জেতানোর পর কিছুদিন অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্বও পালন করেছিলেন জাগালো।
সুস্থ হয়ে উঠছেন ব্রাজিলের ‘বুড়ো নেকড়ে’ জাগালো
২০১২ সালে জাগালোর স্ত্রী আলসিনা দে কাস্ত্রো মারা যান। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে ‘প্রফেসর’খ্যাত জাগালোর ব্যাপারে দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার রোনালদো বলেছেন, ‘তিনি তাঁর প্রজন্মে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। চারবার বিশ্বকাপ জয়ের পর ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে তাঁর ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।’